বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ধানমন্ডির বাড়ি নিলামে উঠছে।
Published : 29 Jul 2016, 11:08 AM
জিএমজি এয়ারলাইন্সের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় সালমান এফ রহমান এবং তার বড় ভাই সোহেল এফ রহমানের মালিকানাধীন ধানমন্ডির ওই বাড়ি বন্ধকী সম্পত্তি হিসাবে নিলাম করে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক।
গত ১২ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত জিএমজির কাছে ব্যাংকের মোট পাওনা ২২৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
ওই টাকা ফেরত না দেওয়ায় ৩ আগস্ট ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে ওই বাড়ির নিলাম হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
ধানমন্ডির ২ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর প্লটে (নতুন) ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি ও তার উপরের ভবনসহ সব স্থাপনা এই নিলামে উঠবে।
সালমান এফ রহমান অবশ্য ৩ অগাস্টের আগেই সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার বিষয়ে আশাবাদী।
বৃহস্পতিবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা আগেই এ বিষয়ে হাই কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে রেখেছি। সে কারণে ৩ অগাস্ট নিলাম হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর তার আগেই আমরা বিষয়টি সেটেল করে ফেলব।”
“আমরা নিলামের জন্য যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম সে অনুযায়ীই নিলাম হবে।... ৩ অগাস্ট অবশ্যই নিলাম হবে।”
সালমান রহমান হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ পাওয়ার যে দাবি করেছেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সোনালী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, স্থগিতাদেশের কথা তারাও ‘লোক মুখে’ শুনেছেন।
“কিন্তু কোন বিষয়ে, কিসের স্টে অর্ডার নিয়েছেন- সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত হাই কোর্টের কোনো কপি বা লিখিত কিছু আমাদের কাছে আসেনি।... সে কারণেই বলছি, নিলাম অবশ্যই হবে।”
২০০৬ সালে জিএমজির নামে যখন সোনালী ব্যাংক থেকে ওই ঋণ নেওয়া হয়, তখন এর ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬৫ কোটি টাকা। কিন্তু এখন সুদ ও ঋণের স্থিতি বেড়ে তা ২২৮ কোটি ১৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
দিদার বলেন, নিলাম ডাকার আগে পাওনা আদায়ে সব ধরনের পদক্ষেপই তারা নিয়েছেন। চূড়ান্ত তাগাদা দেওয়া, উকিল নোটিস পাঠানোসহ নিয়ম অনুযায়ী সবই করা হয়েছে। তারপরও টাকা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায়ের সিদ্ধান্ত নিতে তারা বাধ্য হয়েছেন।
যদি নিলামে কেউ অংশ না নেন, অর্থাৎ বাড়ি বিক্রি না হয়; কিংবা বাড়ি বিক্রি করে যদি ঋণের পুরো টাকা পাওয়া না যায়, তাহলে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ধানমন্ডির ওই বাড়ির আশপাশে বেক্সিমকো গ্রুপের বেশ কয়েকটি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইয়েলোর শো রুম রয়েছে। অবশ্য পরিবার নিয়ে সালমান থাকেন গুলশানের একটি বাড়িতে।
সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ঋণ খেলাপির তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ীর।
১৯৯৬ সালের কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন যেসব মামলা করেছিল, তাতে সালমানকেও আসামি করা হয়। তার সেই মামলা ২০১৪ সালে হাই কোর্টের স্থগিতাদেশে আটকে যায়।
সোনালী ব্যাংকের নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে জিএমজি এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান হিসেবে সালমান এফ রহমানের নাম লেখা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান এর চেয়ারম্যান।
কেবল ব্যাংকের কাছে নয়, পুঁজিবাজারেও সঙ্কটে রয়েছে তাদের জিএমজি।আর্থিক প্রতিবেদন জালিয়াতি করে শেয়ারবাজার থেকে নেওয়া ৩০০ কোটি টাকা ৭ বছরেও ফেরত দেয়নি এ কোম্পানি।
আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) আগে মূলধন বাড়াতে নির্দিষ্ট কিছু বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রি করতে পারে কোম্পানি। শেয়ারবাজারের পরিভাষায় একে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট বলা হয়। ওই কোম্পানি শেষ পর্যন্ত বাজারে তালিকাভুক্তির সুযোগ না পেলে প্লেসমেন্টের টাকা ফেরত দিতে হয়। সেইসঙ্গে যতদিন টাকা আটকে রাখা হয়েছিল, তার ওপর লভ্যাংশ দিতে হয় বিনিয়োগকারীদের।
প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির সময় জিএমজি ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের সঙ্গে ৪০ টাকা প্রিমিয়াম ধরে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে নেয়। এভাবে বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয় ৩০০ কোটি টাকা।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের বছর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করে টানা ৭ বছর লোকসানে ছিল জিএমজি এয়ারলাইন্স।
ওই সময়ে তাদের মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪২ কোটি টাকা। এরপর ২০০৬ ও ২০০৭ সালে এ কোম্পানি ১ কোটি টাকা মুনাফা দেখায়।
বেক্সিমকো গ্রুপ ২০০৯ সালে এই এয়ারলাইন্সের বেশিরভাগ শেয়ার কিনে নেওয়ার পর ২০১০ সালে রাতারাতি বেড়ে যায় তাদের মুনাফা। ওই বছর প্রথম ৯ মাসে ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মুনাফা দেখায় তারা।
২০১০ সালের শেয়ারবাজারে কারসাজি নিয়ে গঠিত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের স্থিতিপত্রে হঠাৎ করে ৩৩ কোটি টাকার পুনঃমূল্যায়ন উদ্বৃত্ত দেখানো হয়। এর ব্যাখায় জিএমজি বলেছে, তাদের দুটি বিমানের সম্পদ পূনঃমূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে বিমান দুটি বেশ পুরোনো। স্বাভাবিক নিয়মে পুরোনো বিমানের সম্পদের দাম আরও কমার কথা।
ওই অবস্থায় ১৬৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি জিএমজি আরও ৩০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহের জন্য আবেদন করে। কিন্তু কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি ধরা পড়ায় ২০১২ সালে আইপিও আবেদনটি বাতিল করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বেক্সিমকো গ্রুপ জিএমজি কিনে নেওয়ার আগে এই এয়ারলাইন্সের কর্ণধার ছিলেন সাহাব সাত্তার। বেক্সিমকো কিনে নেওয়ার পর জিএমজির সামান্য কিছু শেয়ারের মালিক সাহাব সাত্তার কার্যত প্রতিষ্ঠানটির ‘কর্তৃত্বহীন’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।