মঈনুল হক চৌধুরী, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
ঢাকা, ডিসেম্বর ৭ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)--- নির্বিচারে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্যাভাব ও পরিবেশের সার্বিক ভারসাম্যহীনতার কারণে দেশের প্রায় ৯শ' প্রজাতির বন্যপ্রাণীর দেড়শই আজ বিলুপ্তির পথে। এ প্রজাতিগুলো আজ 'অতি বিপন্ন', 'বিপন্ন' ও 'ক্ষতিগ্রস্ত' তালিকায়।
জলবায়ু পরিবর্তন তাদের প্রতি নতুন বিপত্তি হিসেবে আর্র্বিভূত হচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া বন্যপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক কারণে বনাঞ্চলে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত বৈধ-অবৈধ হস্তক্ষেপের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
বন-পাহাড়-জলাভূমির আবাস বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও সংরক্ষণ কার্যক্রমের দুর্বলতা বা আদৌ না থাকা, দুর্বল আইন, চোরা শিকার, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও দূষণসহ পরিবেশের সামগ্রিক ভারসাম্যহীনতা পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা এজন্য বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা নিরাপদ রাখার পাশাপাশি নতুন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন যুগোপযোগী করা ও তা প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জাফর আহমেদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তুলে ধরলেন সমস্যার নতুন দিক জলবায়ু পরিবর্তনকে।
"যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে তারা আজ পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই আজ কোনো না কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এই বন্যপ্রাণীর ওপর। আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে অনেক অতি বিপন্ন প্রজাতিই বিলুপ্ত হতে পারে", বললেন জাফর আহমেদ।
একই সতর্কতা শোনালেন ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (ডব্লিউটিবি)-এর প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলামও। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন বন্যপ্রাণীর জন্য একটি বড় বিপদ হিসেবে দেখা দেবে। যেভাবে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বাড়ছে তাতে বিপন্ন প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি তরান্বিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হবে নিরাপত্তাহীন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।"
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন আইইউসিএন-এর তথ্য মতে স্মরণকালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গণ্ডার, বনগরু, নেকড়ে, দুই জাতের হরিণ, হায়েনা, বনমহিষ, নীলগাই, কয়েক প্রজাতির পাখি এবং এক প্রজাতির সরীসৃপ। 'বিপন্ন' পর্যায়ে রয়েছে ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪৭ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাজী সৈয়দ মোহাম্মদ আসমত বলেন, টেকনাফ, সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী, সিলেট ও তিন পার্বত্য জেলায় গহীন বনের পরিমাণ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। যে টেকনাফ একসময় গহীন বন ছিল, তা আজ প্রায় উন্মুক্ত প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। এখন বনের মধ্যে এমন কোন জায়গা পাওয়া যাবে না যেখানে মানুষের পদচারণা নেই।
সীতাকুণ্ডের প্যারা ও মায়া হরিণ, কাপ্তাইয়ের চিতা বাঘ, হাতি ও বার্মিজ পাইথন (অজগর), সিলেটের বনরূই, টেকনাফের হাতি, চিতাবাঘ ও ধনেশ পাখি বর্তমানে দুর্লভ প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
ডব্লিউটিবি, আইইউসিএন এবং অন্য বন্যপ্রাণীবিদ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ কার্যক্রম ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই আগামী মাত্র কয়েক দশকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
আইইউসিএন-এর সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি আইনুন নিশাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্যাভাবে এখন বন্যপ্রাণীর জীবন হুমকির মুখে।.. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ১৯৭৪-এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।"
আইনুন নিশাত জানান, ১৯৯৮ সালে আইইউসিএন-এর জরিপে সর্বশেষ দেশের বন্যপ্রাণী পরিস্থিতির হিসাব পাওয়া যায়। এখনই নতুন করে জরিপ করার জন্য সুপারিশ করেন তিনি।
দেশের বন্যপ্রাণীর প্রকৃত হিসাব ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে উচ্চপর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জাফর আহমেদ খান জানিয়েছেন।
ডব্লিউটিবি'র প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম মনে করেন, জনসচেতনতার অভাবও বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির বড় কারণ। তার দেওয়া হিসাবে দেশের ৯০ শতাংশ লোকই জানে না বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংক্রান্ত ২৮টি চুক্তি, কনভেনশন ও প্রটোকলে অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ!
ডব্লিউটিবি'র তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৯০৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩০-৩৫টি উভচর, ১২৬টি সরীসৃপ, ৬৫০টি পাখি এবং ১১৩টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। এরমধ্যে সুন্দরবনে ৩১৫ প্রজাতির পাখি, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ ৪৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, অর্ধশতাধিক সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর রয়েছে। দেশের হাওড়-বাওড়ে রয়েছে প্রায় দেড়শ' প্রজাতির জলচর পাখি যার ৭০ শতাংশই বিরল। ভূখণ্ডের আয়তনের দিক দিয়ে বিশেষ করে বাংলাদেশের পাখি প্রজাতির সংখ্যাকে ঈর্ষণীয় মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ১০টি প্রজাতি ইতিমধ্যেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৪৩টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে লজ্জাবতী বানর, পারাইল্লা বানর, কুলু বানর, উল্লুক, রামকুত্তা, গেছোবাঘ, চিতা বাঘ, উদবিড়াল, ভাল্লুক, শুশুক, বনছাগল, সম্বর, বনরুই, মুখপোড়া হনুমান, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, কাঁকড়াভুক বেজি, ভোঁদড়, কালো ভাল্লুক, বাগডাস, মায়াহরিণ।
পাখির মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে লালশির হাঁস ও ময়ূর। অতি বিপন্ন পাখির তালিকায় রয়েছে কালো তিতির, কাঠময়ুর, বাদিহাঁস, বাঞ্চাহাঁস, রাজধনেশ, পাহাড়ি ঘুঘু, হরিয়াল, কোরাল, লালশির শকুন, হাড়গিলা, পাহাড়ি ময়না, মথুরা, কাওধনেশ, ঈগল প্যাঁচা, হট্টিটি, সাদা ঈগল, মদনটাক প্রভৃতি।
উভচর প্রজাতিতে পটকা, সবুজ ও গেছো ব্যাঙ এখন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
সরীসৃপ প্রজাতিতে বিলুপ্ত হয়েছে মিঠাপানির কুমির। শুধু চিড়িয়াখানা ও খানজাহান আলীর মাজার ছাড়া এদের এখন আর দেখা যায় না। লবণাক্ত পানির কুমির ও মেছো কুমির অতি বিপন্ন অবস্থায় টিকে আছে। কচ্ছপ প্রজাতির মধ্যে বড় কাইটা, কাছিম, হলুদ পাহাড়ি কাছিম অতি বিপন্ন। সাপের মধ্যে নির্বিষ গুলবাহার অজগর, বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়া অতি বিপন্ন এবং কালকেউটে, গোখরা, ভাইপার, কালনাগিনী, দুধরাজ, সবুজ ডোরা প্রভৃতি বিপন্ন সাপের তালিকায় রয়েছে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাজী জাকির হোসেন বলেন, "বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি ও ক্রমহ্রাসের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এজন্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এমএইচসি/এসকে/১৬১৩ঘ.