বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ

বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণের জন্য মন্ত্রী পরিষদ সচিবকে ছয় মাসের মধ্যে একটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ কমিশন গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2015, 07:09 AM
Updated : 1 July 2015, 05:33 PM

পাঁচ বছর আগে দায়ের হওয়া একটি রিট আবেদনের রায়ে বুধবার বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের হাই কোর্ট বেঞ্চ এটিসহ তিনদফা নির্দেশনা দিয়ে দেয়।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও আইন কার্যকর করার দাবিতে ২০১০ সালে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ওই রিট আবেদনটি করে।

রায়ে আদালত বলেছে, ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’সাত সদস্যের এই কমিশনের প্রধান থাকবেন আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইনজ্ঞ।

এ ছাড়া কমিশনে গৃহায়ন, নগর উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, একজন অর্থনীতিবিদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয় মনোনীত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, ভোক্তা অধিকার বা বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কাজ বা গবেষণা করে বা বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় মনোনীত যেকোনো সিটি করপোরেশনেরে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কমিশনে থাকবেন।

রায়ে বলা হয়, কমিশন আইনের সংস্কার প্রস্তাব, বাড়িমালিক, আইনজ্ঞ, বিভিন্ন বিভাগ, ভোক্তা অধিকার সংশ্লিষ্টসহ পক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলবে, প্রয়োজনে গণশুনানি করবে, তাদের মতামত ও যুক্তি গ্রহণ করবে, রাজধানীসহ ও অন্যন্য মহানগর শহর, অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ সবোচ্চ ও সর্বনিন্ম ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব দিবে। পাশাপাশি  দেশের ভাড়াটিয়া ও মালিকের সমস্যা চিহ্তি করে নিরূপন ও প্রতিকারে স্বয়ংসম্পূর্ন আইনি কাঠামো প্রনয়নে সুপারিশ করবে।

অপর নির্দেশনায় বলা হয়, “কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে সরকার বিদ্যমান বাড়িভাড়া আইন সংস্কারেরও উদ্যোগ নেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।”

গঠিত কমিশন যেসব সুপারিশ করবে, তা আইনি কাঠামোর রূপ না পাওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে বিশেষ করে ঢাকায় বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন করে নিয়ন্ত্রক নিয়োগের উদ্যোগ নিতে বলেছে হাই কোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, সরকার ‘আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে’ এই উদ্যোগ নেবে।

এছাড়া প্রস্তাবিত কমিশনের সুপারিশ আকারে আইনি কাঠামোতে আসার আগ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে বেআইনিভাবে কোনো ভাড়াটিয়াকে যাতে উচ্ছেদ বা ভয়ভীতি দেখানো হলে এবং কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তা যাতে দ্রুত মেটানো  এবং প্রয়োজনে ক্ষতিগ্রস্তকে সুরক্ষার ব্যবস্থা যাতে নেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

রিট আবেদনকারীর  আইনজীবী মনজিল মোরসেদ রায়ের পর বলেন, “রায়ে খুবই খুশি। বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মানুষ যে অপেক্ষা করছিল সেই পথ খুলে গেল। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিরোধ শতকরা আশি ভাগ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।”

তিনি বলেন, “আদালত এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। ওই কর্তৃপক্ষের অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে।”

বাড়িভাড়া বাড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের মধ্যে অধিকাংশ বিরোধ সৃষ্টি হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

আর আদালতে এই রিট আবেদন হওয়ার আগে ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাড়িভাড়া।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট আবেদনে বলা হয়, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াসহ বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক বাড়িওয়ালা আইন ভেঙে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান, যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন। তারা ভাড়াটেদের বাড়ি ভাড়ার রশিদ দেন না।

ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১০ সালের ১৭ মে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান কার্যকর করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাই কোর্ট।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের এর জবাব দিতে বলা হয়।

ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি ২০১৩ সালের ৯ মে মাসে শেষে রায় অপেক্ষমান রাখা হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই রায় এল।                                             

স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন

রায়ে আদালত বলেছে, নাগরিকদের জীবনধারণের অন্যান্য মৌলিক উপকরণের ন্যায় আশ্রয়লাভ আবাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।সেখানে আবাসন ব্যবস্থাকে একটি অনয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আদালত বলে, ভাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে জটিল অর্থনীতি, সামাজিক ও আইনি বিষয় জড়িত।..একটি বহুমাত্রিক ব্যাপক এবং স্বয়ংসম্পূর্ন আইন কাঠামো প্রনয়ণে স্বতন্ত্র সরকারি ভাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।এমন কর্তৃপক্ষ সময় সময়ে আবাসন ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, বাড়ি মালিক, ভাড়াটিয়া ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে মানসম্মত, ফেয়ার ও পরিমিত ভাড়া নির্ধারণ করতে পারবে।একটি মডেল ভাড়া চুক্তি প্রনয়ন করবে।