নাইকো দুর্নীতি মামলার বৈধতা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আবেদন খারিজ করে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 18 Jun 2015, 01:37 PM
এই আদেশ পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জরুরি অবস্থার সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এই মামলা চ্যালেঞ্জ করে খালেদার রিট আবেদনে সাত বছর আগে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট। সে সময় জারি করা রুল খারিজ করেই বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।
এর ফলে খালেদার বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার বিচার চালাতে আর কোনো বাধা থাকল না বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন এ মামলাটি অভিযোগ গঠন পর্যায়ে রয়েছে।
রায়ের পর খালেদার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, তারা আপলি করবেন।
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “ফৌজদারি মামলা নিয়ে রিট আবেদন চলে না। মামলার অনুমোদন সঠিক আছে। এসব কারণে হাই কোর্ট রায় দিয়েছে।”
সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার ‘দুর্নীতি’
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় নাইকো দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। পরের বছর ৫ মে খালেদাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এতে অভিযোগ করা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।
খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেলে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই দুর্নীতির এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে হাই কোর্ট, সেই সঙ্গে দেওয়া হয় রুল।
মামলা দায়ের কেন আইনগত কর্তৃত্ববর্হিভূত ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এ মামলায় জামিন পান খালেদা।
প্রায় সাত বছর পর চলতি বছর শুরুতে রুল নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেয় দুদক। খালেদার আবেদনে রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় ১৯ এপ্রিল। শুনানি শেষে ২৮ মে আদালত রায় অপেক্ষমান রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণা করে।
খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, রাগীব রউফ চৌধুরী ও এ কে এম এহসানুর রহমান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল আব্দুর রকিব মন্টু রায়ের সময় উপস্থিত ছিলেন।
নাইকোকে কাজ দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিযোগে খালেদার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও একই দিনে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক।
আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ২০১০ সালের মার্চে হাই কোর্ট ওই মামলা বাতিল করে দেয়। রায়ে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই মামলাটি করা হয়েছিল।
বিচারিক আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ‘বেআইনি কাজ’করেছে উল্লেখ করে উচ্চ আদালত ওই রায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিধিমালাও সংশোধন করতে বলেছিল।
এ প্রসঙ্গ টেনে রাগীব রউফ হাই কোর্টের শুনানিতে বলেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলাটি যে কারণে বাতিল করা হয়েছে, একই কারণে বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলাটিও চলতে পারে না।
আর তখনকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চুক্তি অনুমোদন করায় খালেদার বিরুদ্ধে এভাবে ফৌজদারি মামলাও চলতে পারে না বলে শুনানিতে দাবি করেছিলেন এই আইনজীবী।
যে কারণে খারিজ
বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, “রিট আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। রুল খারিজ করা হল।
“এই আদেশ বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর দুই মাসের মধ্যে আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হল।”
বিচারক রায়ে বলেন, “নিম্ন আদালত জামিন চাইলে আদালত জামিন বিবেচনা করবেন, কেননা আবেদনকারী (খালেদা) জামিনের অপব্যবহার করেননি।’
মহীউদ্দিন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে দুদকের করা একটি মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে হাই কোর্ট বলেছে, কোনো মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় একবার কমিশনের অনুমোদন নিলেই হবে। মামলার প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
আরেকটি মামলার প্রসঙ্গ টেনে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, রিট আবেদনে ফৌজদারি কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করা যায় না, যদি না তা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।
খালেদার আবেদনে যেহেতু দুদক আইনের কোনো ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি, সেহেতু এক্ষেত্রে রিট আবেদন চলে না বলে রায়ে বলা হয়।
আদালত বলেন, দুর্নীতি বা ফৌজদারি অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীসভাকে সংবিধানে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নাইকো মামলা বাতিলের প্রসঙ্গও খালেদার মামলার রায়ে এসেছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা চুক্তির পদ্ধতি অনুমোদন করেছিলেন। তার মামলায় হাই কোর্ট বলেছে, পদ্ধতি অনুমোদনের জন্য ফৌজদারি দায় বর্তায় না। ওই পদ্ধতি অনুসরণ করে খালেদা জিয়া চুক্তির সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেন।
“এ মামলার আসামি সেলিম ভূইয়া তার জবানবন্দিতে বলেছেন, চুক্তি নিশ্চিত করার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এ রকম অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ আসেনি।”
আইনজীবীরা যা বলেন
রায়ের পর মাহবুব উদ্দিন খোকন আপিল করবেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এ মামলায় নেই।”
তাহলে খালেদার আবেদন খারিজ হল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আদালত বলেছে, দুদক এ মামলা দায়েরের যে অনুমোদন দিয়েছিল, তা সঠিক ছিল। এ কারণে রুল খারিজ করা হয়েছে।”
খুরশীদ আলম খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খালেদার মতো শেখ হাসিনার মামলাতেও একবারই কমিশনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল।ওই কারণেই ওই মামলা অনুমোদন দেওয়া অবৈধ ছিল বলে হাই কোর্ট রায়ে জানিয়েছিল। এ বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়টি এসেছে পরে। এ কারণে খালেদার আবেদন আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
“ফৌজদারি মামলা নিয়ে রিট আবেদন চলে না, আমরা বলেছি। রিট আবেদনে ফৌজদারি মামলা চ্যালেঞ্জ করতে হলে আইন বা উপধারা চ্যালেঞ্জ করতে হয়। খালেদা জিয়ার আবেদনে কোনো আইন বা আইনের উপধারা চ্যালেঞ্জ করা হয় নাই। কাজেই রিট গ্রহণযোগ্য নয়।’
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মামলায় ‘তফাৎ আছে’ মন্তব্য করে দুদকের আইনজীবী বলেন, খালেদা জিয়ার মামলায় একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আছে। আদালত এ বিষয়ে আলোচনা করেছে।..এখানে অপরাধের ও ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের উপাদান আছে, যেটা দেখবে নিম্ন আদালত।..প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে সহয়তা, বিশ্বাসভঙ্গের অপরাধের উপাদান আছে।”
আদালত রুল খারিজ করায় এ মামলা চলতে আর আইনি কোনো বাধা থাকল না বলে জানান তিনি।
আর যারা আসামি
খালেদা জিয়া ছাড়া এ মামলার বাকি আসামিরা হলেন- চার দলীয় জোট সরকারের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া (সিলভার সেলিম) এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।