ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে খরচের যে হিসাব প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে দিয়েছেন, তাতে কারও ব্যয় ইসির বেঁধে দেওয়া সীমা ছাড়িয়ে যায়নি।
Published : 08 Jun 2015, 11:25 AM
এমনকি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক প্রার্থী তার ব্যয়ের প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, মেয়র পদে ভোটে লড়তে তার একটি পয়সাও খরচ হয়নি।
নির্বাচন কমিশন ব্যয়সীমা বেঁধে দিলেও মাঠের পরিস্থিতি তদারকির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রার্থীদের দেওয়া প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রায় সব মহলেই প্রবল সন্দেহ রয়েছে।
দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি সম্প্রতি দাবি করে, গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থীরা তাদের সীমার চেয়ে সাত থেকে ২১ গুণ পর্যন্ত বেশি ব্যয় করেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদও বলেছেন, অনেকেই ‘সঠিক তথ্য’ দেন না। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় যাচাই-বাছাই করে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ ইসি নেবে।
ঢাকা উত্তরে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনিসুল হক প্রায় ৪৯ লাখ টাকা এবং দক্ষিণে সাঈদ খোকন প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ের হিসাব দিয়েছেন।
আর তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল প্রায় ৪৪ লাখ টাকা এবং মির্জা আব্বাস সাড়ে ১৯ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন।
কিন্তু প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী মো. জাহিদুর রহমানের কোনো টাকা পয়সা খরচ করতে হয়নি।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এবার মেয়র পদে ৩৬ জন এবং কাউন্সিলর পদে আট শতাধিক প্রার্থী ছিলেন।
ভোটের পর ৩০ এপ্রিল নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশ করে ইসি। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ২৯ মে’র মধ্যে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল।
ভোটার সংখ্যার অনুপাতে এবার মেয়র পদের প্রার্থীদের জন্য উত্তরে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা এবং দক্ষিণে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ের সুযোগ ছিল।
প্রার্থীরা নির্ধারিত সময়ে ব্যয়সীমার মধ্যেই নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দেখিয়েছেন। এসব তথ্য সঠিক কিনা তা এখনো যাচাই বাছাই করা হয়নি বলে জানান দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম ও মিহির সারওয়ার মোর্শেদ।
ঢাকা দক্ষিণে ল্যাপটপ প্রতীকের মো. জাহিদুর রহমান তার হলফনামায় ব্যয় দেখিয়েছেন ‘শূন্য টাকা’। তিনি পেয়েছেন ৯৮৮ ভোট।
এই সিটিতে সবচেয়ে কম, ৩১২ ভোট পেয়েছেন বাহরানে সুলতান। তিনিও ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটে দাঁড়িয়ে এক পয়সাও খরচ হবে না এটা ‘অসম্ভব’। অন্তত ভোটার তালিকার সিডি তাদের কিনতেই হবে, আর ব্যয় তাদের দেখাতে হবে।
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জাহিদুর যে হলফনামা দিয়েছিলেন, তাতে তার পেশা ব্যবসা বলা হলেও কিসের ব্যবসা তিনি করেন, তার উল্লেখ ছিল না।
ব্যবসা থেকে বছরে ২ লাখ টাকা আয়ের তথ্য নির্বাচন কমিশনে দিয়ে জাহিদুর বলেছিলেন, ২ লাখ নগদ টাকা ছাড়া আর কোনো ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, ঋণ বা দায় তার নেই।
হলফ নামায় জাহিদুরের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে- ৫৫/১, বেগমগঞ্জ লেন, নারিন্দা, পো: ঢাকা সদর, থানা: গেণ্ডারিয়া, জেলা: ঢাকা। আর স্থায়ী ঠিকানার জায়গায় তিনি লিখেছেন গ্রাম: পাদুয়ারপাড়, ডাক: পাঠানবাজার, থানা: মতলভ (উত্তর), জেলা: চাঁদপুর। শিক্ষাগত যোগ্যতার জায়গায় লেখা হয়েছে ‘অষ্টম শ্রেণি পাস’।
শেষ পর্যন্ত ‘ব্যয় হয়নি’ জানালেও জাহিদুর রহমান নির্বাচনের আগে তিন লাখ টাকা খরচের সম্ভাব্য হিসাব দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে পোস্টার বাবদ ২২ হাজার, ক্যাম্প/অফিস খরচ হিসাবে ৪০ হাজার টাকা, যাতায়াতে ৮৫ হাজার ৫০০, টাকা, লিফলেট ও স্টিকারে ২০ হাজার টাকা, ডিজিটাল ব্যানারে ৫৭ হাজার টাকা, পথসভায় ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা, মাইকিংয়ে ২৬ হাজার টাকা, অফিস আপ্যায়নে ১৩ হাজার, বিজ্ঞাপনে ১০ হাজার টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
উত্তরে ‘সীমার কাছাকাছি’ আনিসুলের ব্যয়
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচিত টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী ব্যবসায়ী আনিসুল হক তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট রুবানা হকের মাধ্যমে গত ২৭ মে হলফনামা আকারে ভোটের ব্যয়ের প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রায় ৪৯ লাখ টাকা খরচের যে হিসাব তিনি দেখিয়েছেন, তাতে ১০২টি ভাউচারের মাধ্যমে ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ৬২৫ টাকা এবং চারটি চেকের মাধ্যমে ১১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর আনিসুল তার ব্যক্তিগত ব্যয় দেখিয়েছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
ভোটার তালিকার সিডি কেনা ও ফটোকপিতে ৭৮ হাজার টাকা, ভোটের প্রচার বাবদ (নতুনবার্তা, বাংলামেইল, প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট ও সমকালে ১০ হাজার টাকা করে; এনটিভিতে ১৫ হাজার টাকা এবং বাংলালিংকে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও রবিতে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা) মোট ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন আনিসুল হক।
বাকি ব্যয় তিনি দেখিয়েছেন- ক্যাম্প স্থাপন, আপ্যায়ন, কর্মী ভাতা, ঘরোয়া বৈঠক, মাইকিং, প্রতীক, হ্যান্ডবিল, স্টিকার, পথসভা, পোস্টার ও লিফলেট বাবদ।
জনপ্রতি দৈনিক ৫০০ টাকা করে ১৩ দিন কর্মীদের খরচ দিয়েছেন আনিসুল হক। ৩৬টি ওয়ার্ডের ২৫টি থানায় মাত্র ৫ জন করে কর্মী দেখিয়ে এ বাবদে ৮ লাখ টাকার হিসাব তিনি দেখিয়েছেন।
বাস প্রতীকের প্রার্থী তাবিথ আউয়াল নির্বাচনী ব্যয় দেখিয়েছেন ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ২৭৩ টাকা। এছাড়া ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৭০ টাকা ব্যক্তিগত ব্যয়ের কথা বলেছেন তিনি।
অফিস স্থাপন, ভোটার তালিকার সিডি কেনা, ফেইসবুক প্রচারণার জন্যে ভিডিওগ্রাফি ও মোবাইল এসএমএস বার্তার ব্যয়ের হিসাব তিনি ইসিতে দিয়েছেন।
কর্মীদের জন্য প্রতিদিন জনপ্রতি ৭৫ টাকা করে ১৫ দিনে ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন তাবিথ। তার দাবি, প্রতিটি ওয়ার্ডে তার কর্মী ছিল ১০ জন করে।বাকি ব্যয় তিনি দেখিয়েছেন অন্যান্য খাতে।
ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম সব মেয়র প্রার্থীর তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, পরে ইসির ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হবে।
আব্বাসের চেয়ে ৯ লাখ টাকা বেশি ব্যয় খোকনের
রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচিত মোহাম্মদ সাঈদ খোকন (ইলিশ মাছ প্রতীক) ২৮ লাখ ৩৫ হাজার ১১২ টাকা ও মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (মগ প্রতীক) ১৯ লাখ ১৩ হাজার ১৭০ টাকা নির্বাচনী ব্যয় দেখিয়েছেন।
মেয়র পদের অপর প্রার্থীদের মধ্যে আবু নাছের মুহাম্মদ মাসুদ হোসাইন (চরকা) ৭৮ হাজার ৬১৬ টাকা; এ এস এম আকরাম (ক্রিকেট ব্যাট) ৩৪ হাজার ১০০ টাকা; অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আয়ুব হুসেন (ঈগল) ১৬ হাজার ৫০০ টাকা; এসএম আসাদুজ্জামান রিপন (কমলালেবু) ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা; দিলীপ ভদ্র (হাতি) ২৮ হাজার ৫০০ টাকা; বজলুর রশীদ ফিরোজ (টেবিল) ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৬০ টাকা; মশিউর রহমান (চিতাবাঘ) ১৯ হাজার ৫৯৫ টাকা; মোহাম্মদ শফি উল্লাহ চৌধুরী (ময়ূর) ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য দিয়েছেন।
এছাড়া মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন (সোফা) ৯ লাখ ৭ হাজার; মো. আকতারুজ্জামান ওরফে আয়তুল্লাহ (লাউ) ২৩ হাজার ৭৮০ টাকা; মো. আব্দুর রহমান (ফ্লাক্স) ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩শ টাকা; মো. আব্দুল খালেক (কেক) ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৪০ টাকা; মো. গোলাম মাওলা রনি (আংটি) ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮১০ টাকা; মো. বাহারানে সুলতান বাহার (শার্ট) ৫০ হাজার টাকা; মো. রেজাউল করিম চৌধুরী (টেবিল ঘড়ি) ৫ লাখ ৩৬ হাজার; মো. শহীদুল ইসলাম (বাস) ৩৯ হাজার ৫শ টাকা; শাহীন খান (জাহাজ) ৪০ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন বলে তাদের হলফনামায় বলা হয়েছে।