ব্যয়সীমা বেঁধে দিয়েই খালাস ইসি

সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও মাঠে কে কতো খরচ করছেন তা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই নির্বাচন কমিশনের হাতে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2015, 08:50 AM
Updated : 23 April 2015, 08:53 AM

লোকবল সংকটের কথা বলে কার্যত এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি, যদিও নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে ‘কালো টাকা’ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন একাধিক প্রার্থী।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বলেছেন, তারাও নির্বাচনে ‘কালো টাকার’ ব্যবহার বন্ধ করতে চান। তবে তা ঠেকাতে নিজেদের কোনো ব্যবস্থা তারা রাখেননি। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন সিইসি।

আগামী ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। এ নির্বাচনের প্রচার শুরু হয়েছে গত ৭ এপ্রিল থেকে।

নির্বাচনে ভোটার হিসেবে ঢাকা উত্তরে মেয়র প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৩০ লাখ টাকা করে ব্যয় করতে পারবেন বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। আর কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যয় সীমা এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

পোস্টার ছাপানোর পাশাপাশি অন্য প্রচারণা, পরিবহন, পথসভা-ঘরোয়া সভা, নির্বাচনী ক্যাম্প, এজেন্ট ও কর্মীদের খরচ, আবাসন ও প্রশাসনিক ব্যয় বাবদ এই খরচ করতে পারবেন প্রার্থীরা। এছাড়া প্রার্থীর ব্যক্তিগত ব্যয়ও নির্ধারিত রয়েছে।

নির্বাচনী ব্যয় এবং কোথা থেকে সেই টাকা এসেছে তার বিবরণ নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হবে প্রার্থীদের। প্রার্থীদের ব্যয় বিবরণী ‘স্বচ্ছতার স্বার্থে’ নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক।

তবে এভাবে ‘দায় সারায়’ কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেছেন কয়েকজন প্রার্থী।

ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী জোনায়েদ সাকির অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে এখন সরাসরি ‘টাকার খেলা’ চলছে।

গণসংহতি আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ব্যয় তদারকিতে নির্বাচন কমিশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।

“অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যয় সংক্রান্ত বিধি মেনে চলাটা প্রতিযোগিতার অন্যতম শর্ত।”

ঢাকা উত্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েক মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “বিভিন্ন মিডিয়ায় বিশেষত, অনলাইনে বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে নির্বাচনী এলাকায়  প্রচুর টাকা ছড়ানো হচ্ছে। এটা যেন বাজিকরের খেলায় পরিণত হয়েছে। ভোটারদের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।”

ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘অতিরিক্ত’ টাকা খরচের অভিযোগ করেছেন ওই সিটিতে সিপিবি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন (কাফি রতন)।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচনে মোট ৫০ লাখ টাকা খরচ করার কথা থাকলেও কোনো কোনো প্রার্থী প্রতিদিনই সেই পরিমাণ টাকা ব্যয় করছেন বলে তাদের কাছে খবর রয়েছে।

“বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার বিষয়ে তেমন খোঁজ-খবর না পেলেও ঘনিষ্ঠজনরা থাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর প্রচার কার্যক্রমের খবর আমার কাছে আসছে।

“প্রতিটি থানায় একটি নির্বাচনী ক্যাম্প থাকার কথা থাকলেও তার পক্ষে ওয়ার্ড প্রতি ৯ থেকে ১০টি নির্বাচনী অফিস রয়েছে, যেখানে প্রচুর খরচ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি প্রতিটি পোস্টার লাগাতে ৫ থেকে ৬ টাকা করে দেওয়া হয়; সেখানে ঢাকা শহরে লাখ লাখ পোস্টার লেগেছে।”

এছাড়া অনলাইনে ‘পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে’ নির্বাচনী আইনের লংঘন হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “টাকার জোরে পত্রিকার অনলাইনে সমগ্র পাতাজুড়ে এদিক-সেদিক বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্বাচনী বিধির লংঘনের বিষয়ে আজই (বৃহস্পতিবার) নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করার চিন্তা রয়েছে।”

প্রতিদ্বন্দ্বী কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘কালো টাকা’ ব্যবহারের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, নির্বাচনে ‘কালো টাকার’ ব্যবহার পেশী শক্তির ‘প্রয়োগ’ ঘটায়।

‘কালো টাকা’, ‘পেশী শক্তি’, ‘ধর্মের ব্যবহার’ বন্ধ এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতে ‘বাংলাদেশের সামনে সহিংস রাজনীতি থেকে মুক্তি পাওয়ার’ যে সুযোগ এসেছে তা থাকবে না।

এর আগে প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভাতেও অনেক প্রার্থী এ বিষয়ে নজর দিতে কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন।

ভোটের সময় ‘বিকাশ-এর মাধ্যমে’ প্রার্থীদের ‘কালো টাকা’র লেনদেন বন্ধ করার অনুরোধ করেন নির্দলীয় প্রার্থী বাহরানে সুলতান বাহার।

প্রার্থীরা ব্যয় তদারকির দাবি তুললেও তা ‘সামর্থ্যের বাইরে’ বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক।

“এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে এ পর্যন্ত প্রার্থীরা তাদের নির্ধারিত ব্যয়ের হিসাবই কমিশনে জমা দিয়ে এসেছে। বিধি রয়েছে বলেই তারা জমা দেয়, কেউ কখনো এ নিয়ে অভিযোগও করেনি।

“প্রতিটি ওয়ার্ডে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদিন কত ব্যয় করছেন তা ঘুরে ঘুরে দেখার এতো লোকবল কোথায় ইসির? ভোট শেষ হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ব্যয় বিবরণীও জমা দেবে তারা। যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়, কারো ব্যয় নিয়ে সুস্পষ্ট অভিযোগ করে তা খতিয়ে দেখা যাবে।”

বিধি অনুযায়ী প্রার্থীর এজেন্টের মাধ্যমে সব অর্থ খরচ করতে হবে এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে ব্যয়ের হিসাব কমিশনে দাখিল করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনও অনিয়ম ধরা পড়লে প্রার্থিতা বাতিল করা হবে।

নির্বাচনী ব্যয় সীমা নিয়ে উত্তরের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার নির্বাচনী ব্যয় সীমা ৫০ লাখ টাকা। এর চেয়েও কম লাগবে আমার। আমি তো হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ করছি। খরচও কম হচ্ছে। ওই ব্যয়সীমার মধ্যেই থাকতে পারব।”

নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলন, বর্তমান বাস্তবতায় আইনে ব্যয়সীমা নির্ধারিত করা থাকলেও অধিকাংশ প্রার্থীই তার কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করে ফেলেন। তবে ভোট শেষে কমিশনে দেওয়া নির্বাচনী ব্যয়ের ‘রিটার্ন দাখিলের’ সময় ওই নির্ধারিত ব্যয়ই দেখান তারা।

ব্যয় তদারক না করে ভোট শেষে প্রার্থীদের কাছ থেকে ‘মনগড়া’ বিবরণী নিয়ে নির্বাচনে ‘কালো টাকা’ ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন জোনায়েদ সাকি।

তিনি বলেন, “বিপুল অঙ্কের এই টাকা প্রার্থীর ব্যক্তিগত বা অন্য যে উৎস থেকেই আসুক না কেন- তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে সিটি কার্যক্রম পরিচালনায় তার প্রভাব থাকবে। জনগণকে ঠকিয়ে ওই টাকা তুলে নেওয়া হবে।”

এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়সীমা আগের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ভোটার অনুপাতে ব্যয়সীমা নির্ধারিত হয়।

ওই কমিশন তাদের সময়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থীদের সপ্তাহান্তের নির্বাচনী ব্যয় তদারকির ব্যবস্থাও করেছিল। নির্বাচন কর্মকর্তারা তা ‘মনিটর’ করতেন।

ঢাকা উত্তরে ২৩ লাখেরও বেশি এবং ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রামে ১৮ লাখেরও বেশি করে ভোটার রয়েছে। ৪৮ মেয়র প্রার্থী ও ১১শর বেশি কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবারের নির্বাচনে।