যে অপরাধে ঝুলতে হল কামারুজ্জামানকে

একাত্তরে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামকে ‘বিধবাপল্লী’তে পরিণত করতে যিনি মূল ভূমিকা রেখেছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, সেই জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে শেষ পর্যন্ত ঝুলতে হলো ফাঁসির দড়িতে।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 08:51 PM
Updated : 11 April 2015, 09:01 PM

যুদ্ধাপরাধের দায়ে আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় শনিবার কার্যকর করা হয়েছে।

শেরপুরের নালিতাবাড়ি থানার সোহাগপুর গ্রামে ১৯৭১ সালে ১২০ জন পুরুষকে বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যার ঘটনায় তাকে এই সাজা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আপিল বিভাগ সেই রায় বহাল রাখার পর তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ)আবেদনও খারিজ হয়ে যায়।

কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় বিচার শুরুর পাঁচ বছর পর শনিবার সাজা কার্যকর হয়।

২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের মামলার রায় দেয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। সেই রায়ে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের পাঁচটি প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে দুটিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া জয়।

রায়ে বলা হয়, “আসামি যেভাবে এসব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিলে সুবিচার হবে না।”

গত ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে তৃতীয় অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। তবে চতুর্থ অভিযোগে সাজা কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ।

আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, ‘একমাত্র জানোয়ার ছাড়া’ আর কিছুর সঙ্গে কামারুজ্জামানের কর্মকাণ্ডের তুলনা চলে না।

“হত্যা ও ধর্ষণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই ঘটনা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বর। অপরাধ সংগঠনকারীরা কেবল পুরুষদেরকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের হাত থেকে বিধবারাও নিস্তার পাননি।

“এমনকি যে নারীরা অপরাধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পালিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন পর ফিরে এসেছিলেন, তারাও রেহাই পাননি।”

জামায়াতে ইসলামীর আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায় বলে ট্রাইব্যুনালের রায়েই উঠে আসে।

২০১০ সালে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে হাইকোর্টের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, সোহাগপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিত এবং গ্রামবাসীরা নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করত- এমন কারণ দেখিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তিন দিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে।

দৈনন্দিন কাজেকর্মে ব্যস্ত গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের ধরে এনে ১২০ জনকে গুলি করে হত্যা করে তারা। ধর্ষিত হন গ্রামের অসংখ্য নারী।

ওই ঘটনার পরে ‘বিধবাদের গ্রাম’ নামে পরিচিতি পায় সোহাগপুর গ্রাম।

এ অভিযোগে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৩ অগাস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাতে মৃগি নদীর ওপর শেরি ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

এ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, চতুর্থ অভিযোগের ক্ষেত্রে সাজা কমানো হয়ে থাকলে একই ধরনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৃতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রেও সাজা কমানো যায়।

গত ৬ এপ্রিল ওই রিভিউ আবেদনও খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারিত কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি হয়। 

ফাইল ছবি

দুই ঘটনায় যাবজ্জীবন

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা প্রথম ও সপ্তম অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।

আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সাজা বহাল থাকে। তবে সপ্তম অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

প্রসিকিউশনের প্রথম অভিযোগে বলা হয়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একাত্তর সালের ২৯ জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

আর সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়ার ছেলেসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়।

শিক্ষক নির্যাতন: ১০ বছরের সাজা

দ্বিতীয় অভিযোগে একজন শিক্ষককে নির্যাতনের অভিযোগে কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। অমানবিক এ নির্যাতনের ঘটনাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসাবে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

আপিল বিভাগও চূড়ান্ত রায়ে ওই সাজা বহাল রাখে।

এ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা।

ফাইল ছবি

প্রমাণ হয়নি যে দুটি অভিযোগ

সাতটি অভিযোগের মধ্যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে বলে রায় দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। এ দুটি অভিযোগে আপিল করা হয়নি প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকেও। আপিল না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। 

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মো. লিয়াকত আলী ও আরো ১১ জনকে আটক করে ঝিনাইগাতী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে গুলি করে হত্যা করে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করে প্রসিকিউশন।

আর ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতন চলে তাদের ওপর।