সোহাগপুরের খুনি, জামায়াতের মুখপাত্র

একাত্তরে খুনের উৎসব চালিয়ে সেই রক্তে স্নান করেছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সামরিক শাসনামলে রাজনীতির অধিকার ফিরে পেয়ে হয়েছিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখপত্রের সম্পাদক।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 04:29 PM
Updated : 11 April 2015, 08:52 PM

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে শেরপুরের সোহাগপুরে গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে।     

শনিবার ফাঁসিতে ঝোলা কামারুজ্জামান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন উচ্চ মাধ্যমিকের এই ছাত্র।

এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায় বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে উঠে এসেছে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাহিনী গঠন করে কামারুজ্জামান যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘নাৎসি বাহিনীর পাশবিকতার চেয়েও ভয়াবহ’ বলে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছে।

আদালত বলেছে, “একমাত্র জানোয়ার ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে অভিযুক্তের কর্মকাণ্ডের তুলনা চলে না।”

দীর্ঘ পাঁচ বছর বিচার চলাকালে নিজের কৃতকর্মের জন্য আদালতের কাছে কোনো রকমের অনুশোচনা দেখাননি কামারুজ্জামান, যা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদেরও হতবাক করেছে।

যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের সবচেয়ে বড় কুকীর্তি সোহাগপুরের গণহত্যা। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে কামারুজ্জামান ও তার বদর সহযোগীরা।

আপিল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার লেখা রায়ে বলা হয়, “হত্যা ও ধর্ষণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কামারুজ্জামান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই ঘটনা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বর। অপরাধ সংগঠনকারীরা কেবল পুরুষদেরকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের হাত থেকে বিধবারাও নিস্তার পাননি।

“এমনকি যে নারীরা অপরাধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পালিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন পর ফিরে এসেছিলেন, তারাও রেহাই পাননি।”

 “এই সব বর্বর ঘটনায় কামারুজ্জামান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। নাৎসিরাও এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করে নাই।”

জামালপুরে আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে।

মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই, শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায়।

জামায়াতে ইসলামীর তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন তিনি।

এরইমধ্যে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের আনুকূল্যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফেরে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত। আর ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে কর্মকাণ্ড শুরু করে।

১৯৭৮ থেকে এক বছর শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।

১৯৮২-১৯৮৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন কামারুজ্জামান।পরে জামায়াতের সাপ্তাহিক পত্রিকা সোনার বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন।

১৯৯২ সালে দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব দেওয়া হয় কামারুজ্জামানকে।

কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার ‘মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। জামায়াত সংশ্লিষ্ট পত্রিকা নয়া দিগন্ত এবং স্বামীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সোনার বাংলাতেও তিনি লিখতেন।

এই দম্পতির পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার বড় হাসান ইকবাল ওয়ামি এক সময় দিগন্ত টিভির গবেষণা সেলে কাজ করতেন। মিথ্যা তথ্য প্রচারের কারণে টেলিভিশনটি বন্ধ হয়ে গেলে একটি স্টুডেন্ট কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি।

দ্বিতীয় ছেলে হাসান ইকরাম ওয়ালি সুইডেনে মালমো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছেন।

এ দুই ভাই এক সময় ব্লগে লিখতেন, তবে সেসব লেখা এখন আর দেখা যায় না। 

কামারুজ্জামানের তৃতীয় ছেলে হাসান জামান কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করছেন মালয়েশিয়ার একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে। চতুর্থ ছেলে হাসান ইমাম জামায়াত নেতাদের অর্থপুষ্ট ‘ইবনে সিনা’ ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত।

পঞ্চম ছেলে আহমেদ হাসান কৃষিবিদ গ্রুপের মার্কেটিং বিভাগে কাজ করছেন। আর একমাত্র মেয়ে আতিয়া নূর পড়ছেন মিরপুরের মণিপুর স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হলে ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। আর একই বছর ২ অগাস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয় এই জামায়াত নেতাকে।

কামারুজ্জামান যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের আল বদর বাহিনীর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তার পক্ষে দৈনিক সংগ্রামে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনও প্রমাণ হিসেবে আদালতে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করলেও ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি বহাল থাকে।

আদালতের রায়ে বলা হয়, “আলবদর বাহিনী গঠন এবং পরে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবাদের ধর্ষণে কামারুজ্জামানের কার্যক্রম ছিল অমানবিক ও বিভীষিকাময়। এই অপরাধ সংগঠনে আমরা একজন মানুষ ও একটি জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।”

কামারুজ্জামান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা একজন একজন করে সেই গ্রামের মানুষদের হত্যা করে। ছয় ঘণ্টা ধরে এই খুনের উৎসব চালিয়ে এরপর তারা রক্তে স্নান করে।

“এমনভাবে তারা খুনের উৎসব চালাচ্ছিল, যেন তারা পাখি বা প্রাণী শিকার করছে।”

মানবতাবিরোধী অপরাধে এর আগে জামায়াতের আরেক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, “সোহাগপুর গ্রামের হত্যা ও ধর্ষণ আব্দুল কাদের মোল্লার হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও ভয়াবহ। এ কারণে এটাই সবচেয়ে যথাযথ মামলা, যেখানে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র শাস্তি।

আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ করে দিলে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে শনিবার তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।