‘নাৎসিদের চেয়েও ভয়ঙ্কর’ কামারুজ্জামান

একাত্তরে ময়মনসিংহ অঞ্চলে জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন তা তার পূর্বসূরি কাদের মোল্লা, এমনকি নাৎসি বাহিনীর চেয়েও ভয়াবহ ছিল বলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2015, 04:01 PM
Updated : 18 Feb 2015, 04:01 PM

আপিল বিভাগের রায়ে বলেছে, “একমাত্র জানোয়ার ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে অভিযুক্তের কর্মকাণ্ডের তুলনা চলে না।”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কামারুজ্জামানের অনুশোচনা না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে চূড়ান্ত রায়ে বলা হয়েছে, অপরাধী মানসের এই ধরনের কারণে কোনো ধরনের অনুকম্পা পাওয়ার যোগ্যতা আসামি রাখে না।  

আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ গত ৩ নভেম্বর এই রায় ঘোষণা করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর বিচারকদের স্বাক্ষর শেষে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বুধবার এই রায় প্রকাশ করে। রাতেই তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

রায়ের মূল অংশ লেখেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হিসাবে এই মামলায় আপিল বেঞ্চে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

এর আগে কাদের মোল্লার মামলার আপিলের রায়ও তিনি লিখেছিলেন। ওই বেঞ্চে তখনকার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনও ছিলেন। বিচারপতি মোজাম্মেল সেই রায়ে এস কে সিনহার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

একাত্তরে আল বদরের ময়মনসিংহ জেলা শাখা প্রধান কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে।

বিচারপতি এসকে সিনহার লেখা রায়ে বলা হয়, সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডে ওই গ্রামের সকল মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সুরেন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আল বদর ক্যাম্প থেকে এই পরিকল্পনা ও অপারেশন চালানো হয়।

“হত্যা ও ধর্ষণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ওই ঘটনা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অমানবিক ও বর্বর। অপরাধ সংগঠনকারীরা কেবল পুরুষদেরকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের হাত থেকে বিধবারাও নিস্তার পাননি।

“এমনকি যে নারীরা অপরাধের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পালিয়ে গিয়ে ২-৩ দিন পর ফিরে এসেছিলেন, তারাও রেহাই পাননি।”

কামারুজ্জামানের অপরাধের ভয়াবহতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক  পীড়ন তুলে ধরতে গিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী যখন শুনানিতে তার স্বামীকে হত্যা ও তার প্রতি নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় তিনি বারবার নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন।

“৪০ বছর পরও তিনি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। কি বিভীষিকাময় একটা ঘটনা ছিল! একই ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্য কেউ এটা কল্পনাও করতে পারে না।

“এই সব বর্বর ঘটনায় কামারুজ্জমান সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। এই কাজ কারো সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এমনকি নাৎসিরাও এ ধরনের নিষ্ঠুর কাজ করে নাই।”

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, “বিচারের কোনো পর্যায়ে কামারুজ্জামান তার এ ধরনের কাজের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেননি, বরং আস্ফালন দেখিয়েছেন। নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণে তিনি সশস্ত্র গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।”

‘জানোয়ার’ কামারুজ্জামানের জন্য সহানুভূতি নয়

রায়ে বলা হয়, আলবদর বাহিনী গঠন এবং পরে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবাদের ধর্ষণে কামারুজ্জামানের কার্যক্রম  ছিল অমানবিক ও বিভীষিকাময়।

“এই অপরাধ সংগঠনে আমরা একজন মানুষ ও একটি জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।”

আদালত বলেছে, ‘ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে’ কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলে সাধারণ আইনেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে, কারণ এ ধরনের ঘটনা সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়।

“দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য প্রমাণে উঠে এসেছে যে, হত্যার ভয়াবহ ধরণের এই ঘটনা হিন্দুদের বসন্তকালী উত্সবের সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে মানুষ লাল পানিতে ডুব দেয়।

“অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা একজন একজন করে সেই গ্রামের মানুষদের হত্যা করে। ছয় ঘণ্টা ধরে এই খুনের উৎসব চালিয়ে এরপর তারা রক্তে স্নান করে।

মো. কামারুজ্জামান

“এমনভাবে তারা খুনের উৎসব চালাচ্ছিল, যেন তারা পাখি বা প্রাণী শিকার করছে।”

পূর্ণাঙ্গ রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলে, “আমরা এটা ভাবতেও পারি না, একজন বাঙালি হয়ে তিনি কীভাবে এ ধরনের ভয়াবহ অমানবিক কাজে যুক্ত হলেন। দণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কৃপা তিনি পেতে পারেন না।

“সর্বোচ্চ শাস্তিই এই অপরাধের যথাযথ ও উপযুক্ত সাজা। অন্তত এই অপরাধে তাকে কম কোন সাজা দেওয়ার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।”

কাদের মোল্লার চেয়েও ‘ভয়াবহ’ কামারুজ্জামান

আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রথম রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার মামলায় দণ্ড ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, কোনো আসামিকে দণ্ড দেওয়ার সময় কেবল আসামির অধিকারে আদালত সচেতন থাকবে না, বরং ঘটনার শিকার ব্যক্তি এবং সমাজের যৌক্তিক প্রত্যাশার বিষয়ে সচেতন থাকবে।

কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সে বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, “সোহাগপুর গ্রামের হত্যা ও ধর্ষণ আব্দুল কাদের মোল্লার হত্যা ও ধর্ষণের চেয়েও ভয়াবহ। এ কারণে এটাই সবচেয়ে যথাযথ মামলা, যেখানে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র শাস্তি। এই সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনাল ন্যায় বিচার করেছে।”

এই মামলায় আপিলে থাকা বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বর্তমান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে সোহাগপুরের বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ যুক্ত করেছেন। অপর বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী দণ্ডে একমত পোষণ করলেও ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির’ ক্ষেত্রে তার মত ‍দিয়েছেন।

আপিলের সিদ্ধান্ত

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মোট সাতটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গণহত্যা ও ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফা তালুকদারের হত্যার ঘটনা রয়েছে।

প্রথম অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ির কালীনগরের বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং সপ্তম অভিযোগে রোজার দিনে টেপা মিয়ার ছেলেসহ পাঁচজনকে হত্যার কথা রয়েছে। এ দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দেয়।

এছাড়া শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিতীয় অভিযোগে তার ১০ বছরের সাজা হয়।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আপিলের রায়ে প্রথম অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দ্বিতীয় ও সপ্তম অভিযোগে সাজা বহাল থাকে।

তৃতীয় অভিযোগে আসামির অপরাধের বিষয়ে চার বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার মত প্রধান্য পাওয়ায় এই অপরাধে আসামির দণ্ড হবে মৃত্যুদণ্ড।

চতুর্থ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।

৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে বিচারপতি এসকে সিনহার অংশ রয়েছে। এরপর ১৮৮ পৃষ্ঠা থেকে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার অংশ ‍শুরু হয়। ৪৫৬ পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর অংশ।

রায়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর লেখা অংশে বলা হয়, “আপিলকারীর মতো চরম অপরাধীর দণ্ড প্রদানে আমাদেরকে অতিরিক্ত দয়াবান হলে চলবে না। উত্তরাধিকারী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া তার ভয়াল কার্যক্রমের কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে।

“অপরাধের ধরন অনুসারে সাজা প্রদানে আমাদেরকে যথেষ্ট শক্ত হতে হবে।”

রায়ের এই অংশে বলা হয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ক্ষমতাসীনদের কারণেই ‘মানব-দানবরা’ দশকের পর দশক বিচার এড়াতে পেরেছিল। এরা বাংলাদেশকে ‘একাত্তর পূর্ববর্তী অবস্থায়’ ফেরানোর চেষ্টাও করেছিল।

আসামিকে ফাঁসিকাষ্ঠের মুখোমুখী করলেই কেবল ‘ন্যায় বিচার হতে পারে’ বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।