বিধবাপল্লীতে বিচার পাওয়ার স্বস্তি

চার দশক আগে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে খুন আর ধর্ষণের ‘উৎসব’ করেছিলেন যে আলবদর নেতা, সেই মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় চার দশক পর বিচার পাওয়ার স্বস্তি এসেছে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে। 

আবদুর রহিম বাদলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 05:41 PM
Updated : 11 April 2015, 08:54 PM

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামারুজ্জামানের সেই পাশবিকতার শিকার হাফিজা বেওয়া (৬৫) তার স্বামী ইব্রাহিমকেও হারিয়েছেন সে সময়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তিনি তুলে ধরেছিলেন আদালতে।      

শনিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেঁচে থাকতে বিচার দেখে গেলাম, সেজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”

একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও  পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের নারীরা।

এক গ্রামে একসঙ্গে এতজন পুরুষ নিহত হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ নারীকে অকালে বৈধব্য নিতে হয়েছিল বলে সোহাগপুরের নাম হয়ে যায় ‘বিধবাদের গ্রাম’।

এ গ্রামের শহীদ রহিম উদ্দিনের স্ত্রী কুরফুলি বেওয়া (৭৫), শহীদ আব্দুল লতিফের স্ত্রী হাছেন বানু (৭০), শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া (৬৫), শহীদ সিরাজ আলীর স্ত্রী সমলা বেওয়া (৬২), শহীদ বাবর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া (৭৫), শহীদ কাইঞ্চা দেওয়ানের  স্ত্রী আছিয়া বেওয়াসহ (৭৫) বহু নারী সেদিন স্বামী, সম্ভ্রম হারান।

কামারুজ্জামানের ফাঁসির খবরে তারা সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, বলেছেন বিচার পাওয়ার কথা। 

১৯৫২ সালে এই শেরপুরেরই সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একাত্তরে নিজের এলাকার মানুষের বিরুদ্ধে তিনি মেতে ওঠেন হত্যাযজ্ঞে।

সেই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, “আলবদর বাহিনী গঠন এবং পরে সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা ও বিধবাদের ধর্ষণে কামারুজ্জামানের কার্যক্রম ছিল অমানবিক ও বিভীষিকাময়। এই অপরাধ সংগঠনে আমরা একজন মানুষ ও একটি জানোয়ারের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।”

এই ‘কুলাঙ্গার সন্তানের’ ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৪ বছর পর শেরপুর ‘কলঙ্কমুক্ত হল’ বলে মন্তব্য করেছেন সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন।

যুদ্ধাপরাধী এই জামায়াত নেতার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার খবরে শনিবার রাতে শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা, কামারুজ্জামানের মামলার সাক্ষী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বয়ে যায় আনন্দের ঢেউ।

শেরপুর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোখলেছুর রহমান, ডেপুটি কমান্ডার আবুল কাশেম, মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ দে কৃষ্ণ, মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু সালেহ নুরল ইসলাম হিরু, মুক্তিযোদ্ধা তালাপতুপ হোসেন মঞ্জু, মামলার সাক্ষী ও শহীদ স্বজন মোশাররফ হোসেন তালুকদার মানিক সন্তোষ প্রকাশ করে যুদ্ধাপরাধ মামলার বাকি রায়গুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান।

এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেরপুর শহরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কামারুজ্জামানের বাড়ি বাজিতখিলা এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি পুলিশ। এছাড়া বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যদেরও টহলে রাখা হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান।