তিস্তা চুক্তির আশা দিয়ে, চার বছরের দূরত্ব ঘোচাতে ‘সেতুবন্ধ’ হওয়ার আগ্রহ দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ঢাকা সফরকে অভিহিত করেছেন ‘এক নতুন সূচনা’ হিসাবে।
Published : 20 Feb 2015, 08:50 PM
বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় আসার পর শুক্রবার তার প্রথম কর্মসূচি ছিল দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ‘আড্ডা’, যার আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘বৈঠকী বাংলা’।
দুপুরে খাবার সময় এই মতবিনিময়ে নিজে আবৃত্তি করে আর দুই দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠে গান তুলে দিয়ে আড্ডার আমেজেই জমিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের ‘দিদি’।
চার বছর আগে তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে মমতারও ঢাকা আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি বেঁকে বসায় তিস্তা চুক্তি আটকে যায়।
সে সময় স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সই হলেও পরে মমতার বিরোধিতায় দুই দেশের ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টিও ঝুলে যায়।
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়েক দফা চেষ্টায় মমতার মন না গলায় বাড়তে থাকে ঢাকা-কলকাতা দূরত্ব। ফলে মমতার এবারের সফরের উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলেও বাংলাদেশের প্রত্যাশা, এবার হয়তো তিস্তার মীমাংসা হবে।
সেই প্রত্যাশার বিষয়ে যে মমতাও সচেতন- তার কথাতেই তা উঠে এল।
“ব্যাগ গুছানোর আগে চিন্তা ছিল, আবার যেন কোনো বাধা না আসে। কিন্তু সব বাধা ভেঙে যেহেতু এসেছি, তখন সব বাধা ঘুচে যাবে। দিস ইজ এ নিউ বিগিনিং।”
খুলুন মনের দরজা
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের ভূয়সী প্রশংসা করেন ভারতের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী।
“আমাদের সম্পর্ক খুব সুন্দর, একেবারে সাজানো সম্পর্ক। কোনো বাধা আমাদের থাকবে না। মনের বাঁধন কখনো আটকে রাখা যায় না। মনের দরজাটা খুলে দিতে হবে।”
সবাইকে নমস্কার, সালাম ও প্রণাম জানিয়ে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ বলে খোলামেলা মতবিনিময়ে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
“আমি আপনাদের শুনব, আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব। সব কথা তো বলতে পারি না, যতটুকু পারি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।”
তার কথায়, দুই বাংলার মানুষের ‘হৃদয়টা একই ভাষার, সব হৃদয়ে একই ভাষা’।
সোনারগাঁওয়ের বলরুমে অনুষ্ঠানমঞ্চে মমতার একপাশে ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, অন্যপাশে ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ।
বাংলাদেশের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কলকাতার চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, কবি সুবোধ সরকার, চলচ্চিত্র তারকা প্রসেনজিৎ চক্রবর্তী, তৃণমূলের এমপি অভিনেতা দীপক অধিকারী দেব এবং কণ্ঠশিল্পী নচিকেতাও ছিলেন অনুষ্ঠান মঞ্চে।
আর তৃণমূলের এমপি অভিনেত্রী মুনমুন সেন, অভিনেতা ইন্দ্রনীল সেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনমন্ত্রী চলচ্চিত্র পরিচালক ব্রাত্য বসু ছিলেন সামনে অতিথিদের সারিতে।
আড্ডার জড়তা কাটাতে মমতা শুরু করেন বাঁধ ভাঙার ডাক দিয়ে। নিজের লেখা কবিতা ‘মাটি’ আবৃত্তি করে শোনান।
তার আমন্ত্রণে বন্যা গেয়ে শোনান ‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে’। আর নচিকেতা শোনান ‘তুমি আসবে বলে বসন্ত এসে পেরিয়েছে চৌকাঠ’।
অনেক অনুরোধের পর ব্রাত্য বসুও গান ধরেন; তিনি শোনান ‘পুরনো সেই দিনের কথা’। আর ‘নুরুলদীনের সারা জীবন থেকে’ আসাদুজ্জামান নূর হাঁক দেন- 'জাগো বাহে কোনঠে সবায়'।
বঙ্গবন্ধু ভবন, ঢাকাই ছবি, উৎসব
আলোচনা পর্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অনেকের কথাতেই পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখতে না পারা, দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র সহযোগিতা এবং ভারতে যেতে ভিসা জটিলতার কথাগুলো উঠে এসেছে।
জবাবে মমতা বলেন, কলকাতায় বাংলাদেশি চ্যানেল দেখাতে সরকারি কোনো বাধা নেই। কেবল ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিলেই হয়ে যাবে।
“আসুন না, করুন। আমি সকলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। প্লিজ বাংলায় আসুন।”
মমতা বলেন, “আমরা সিনেমার জট খোলারও চেষ্টা করছি। কিন্তু সমস্যা আছে। তার সমাধান করতে হবে। নূরকে চেয়ার করে কমিটি হতে পারে। দুই বাংলার তিনজন করে প্রতিনিধি থাকবে। তারা মিলে দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করবে।”
কলকাতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উৎসব এবং যৌথ সাংস্কৃতিক উৎসব করার আগ্রহের কথাও তুলে ধরেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, দুই বাংলায় যতো ধরনের বাধা আছে, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, তা দূর করতে দুই পক্ষ এক হয়ে কাজ করতে পারে।
মমতা জানান, ওই ভবনটি একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তারপরও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তিনি চেষ্টা করে দেখবেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ সরকার রাজি থাকলে কলকাতায় বঙ্গবন্ধু ভবন নামে একটি ভবন করতে চাই। এজন্য আমরা জায়গা দেব। সেই ভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে একটি জায়গা থাকবে।”
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা শোনার দিনগুলোও উঠে আসে মমতার কথায়। তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’
মমতা জানান, তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চেয়ার করতে চান, বাংলাদেশের পাঠাগারে পাঁচশ বই উপহার দিতে চান, বাংলাদেশের শিল্পীদের পুরস্কৃত করতে চান।
“সব কিছুর মধ্য দিয়ে আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমি গর্ব করি। এ ভাষা মোটেও দুর্বল না। আমরা এক জায়গায় আসলে অনেক কিছু করতে পারি।”
‘আস্থা রাখুন’
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় ছিটমহল বিনিময় ও তিস্তা চুক্তি নিয়ে জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করে নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার আলোচনায় বলেন, দুই দেশের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসানে মমতার এই সফর ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা করেন।
নাট্যবক্তিত্ব আলী যাকেরও একই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, “আপনার মধ্য দিয়ে বাংলা খুঁজে পাই, বাঙালি খুঁজে পাই। আপনি রাজনৈতিক মতপার্থক্য ঘোচানোর চেষ্টা করবেন, আপনি সেতু হিসাবে কাজ করবেন।”
জবাব দিতে দাঁড়িয়ে পরে মমতা বলেন, “নিশ্চয়ই রাখব। আমি সেতু হিসাবে ভূমিকা রাখব।
“আমাদের প্রব্লেম আছে, আপনাদেরও প্রব্লেম আছে। আমি হাসিনাদির সাথে আলোচনা করব। আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দুই দেশে বহমান পদ্মা, মেঘনা, গঙ্গা ও যমুনার উল্লেখ করেন ‘আমাদের সবার নদী’ হিসাবে। তিনি বলেন, “কেউ ভাগাভাগি করতে চাইলেও পারবে না।”
অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশের কাছে মমতা কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, “আপনাদের আলোয় আমরা আলোকিত।.. এ সফরে আসতে পেরে আমি খুশি। এটা গর্বের দিন।... হাসিনাসহ বাংলাদেশের সবাইকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
মমতার ভাষায়, “মনের কোনো বাউন্ডারি নাই। আমরা একই ভাষায় কথা বলি, গান গাই।”
দুই দেশের শিল্পীদের কণ্ঠে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীতে মমতার বৈঠকী বাংলা শেষ হয়।
বিকালে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মমতা। তারপর যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে।
সন্ধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসভবনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া সংবর্ধনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।