যুদ্ধাপরাধী সুবহানের প্রাণদণ্ড

একাত্তরে যার নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী পাবনায় ব্যাপকহারে হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, সেই জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহানের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়েছে আদালত।

আশিক হোসেনকাজী শাহরিন হক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Feb 2015, 05:57 AM
Updated : 18 Feb 2015, 05:57 AM

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

প্রসিকিউশনের আনা নয়টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে সুবহানের দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন তিনি।

একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য সুবহানকে একজন ‘অতি কুখ্যাত’ ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করে বিচারক বলেন, মৃত্যুদণ্ডই তার অপরাধের ‘যোগ্য শাস্তি’। অপরাধের তুলনায় বয়স বিবেচনায় তার সাজা কমিয়ে দিলে তা কোনোভাবেই অর্থবহ হবে না।

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামও রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন।

জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান পাকিস্তান আমলে ছিলেন পাবনা জেলা জামায়াতের আমির ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য।

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সুবহান পাবনায় যে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালান তার বিবরণ এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে। 

সুবহান হলেন জামায়াতের নবম শীর্ষ নেতা, যিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন। 

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান যখন ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন তখন বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে কাঠগড়ায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় সুবহানকে। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। গায়ে খাঁকি হাফ স্যুয়েটারের সঙ্গে মাথায় টুপিও ছিল পাবনা আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক এই হেড মাওলানার।    

প্রসিকিউশনের আনা ১ নম্বর অভিযোগে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে বের করে ২০ জনকে হত্যা; ৪ নম্বর অভিযোগে সাহাপুর গ্রামে ছয়জনকে হত্যা এবং ৬ নম্বর অভিযোগে সুজানগর থানার ১৫টি গ্রামে কয়েকশ মানুষকে হত্যার দায়ে সুবহানকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।

২ নম্বর অভিযোগে পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা গ্রামে পাঁচজনকে হত্যা এবং ৭ নম্বর অভিযোগে সদর থানার ভাড়ারা ও দেবোত্তর গ্রামে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড।

এছাড়া ৩ নম্বর অভিযোগে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গ্রামে কয়েকজনকে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় সুবহানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

প্রসিকিউশন ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে সুবহানকে খালাস দিয়েছে আদালত।  

জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহান।

 

প্রতিক্রিয়া

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ শিপন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আদালত বলেছে- যে অপরাধগুলো তৎকালীন পাবনায় সংঘটিত হয়েছে আব্দুস সুবহান তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইসলামকে অপব্যাখ্যা করে নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করা হয়েছে।”

অন্যদিকে সুবহানের আইনজীবী শিশির মুনির আপিল করার কথা জানিয়ে বলেন, “মামলায় প্রসিকিউশনের দুর্বল সাক্ষ্য-প্রমাণকে আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে আমরা মনে করি তাতে আইনগত ও তথ্যগত ভুল রয়েছে।”

সুবহানকে নির্দোষ দাবি করে তার ছেলে নেছার আহমদ নান্নু বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।”

অন্যদিকে সর্বোচ্চ সাজার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এতে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের ঋণের ক্ষুদ্রতম  অংশ হলেও পরিশোধ হবে।

সুবহানের ফাঁসির রায়ের পর তার জেলা পাবনায় আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

এ মামলার সাক্ষী শহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, “ফাঁসির রায়ে আমরা খুশি হয়েছি। তার এটা প্রাপ্য ছিল। এই রায় প্রাকৃতিকভাবেই পাওয়ার কথা ছিল।”

রায়ে সন্তুষ্ট হলেও এ পর্যন্ত ঘোষিত সব রায় কার্যকর না হওয়ায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গণজাগরণ মঞ্চ, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দুই বছর আগে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে যাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।  

কে এই সুবহান

পাবনা সদরের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল বাশার মোহাম্মদ আবদুস সুবহান মিয়া ওরফে আবদুস সুবহান ওরফে মাওলানা সুবহানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সুজানগর থানার মানিকহাটি ইউনিয়নের তৈলকুণ্ডি গ্রামে। তার বাবার নাম শেখ নাঈমুদ্দিন, মায়ের নাম নূরানী বেগম।

১৯৫৪ সালে সিরাজগঞ্জ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করা সুবহান পাবনা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা এবং আরিফপুরের উলট সিনিয়র মাদ্রাসার সুপারিন্টেডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

পাবনা জেলা জামায়াতের কমিটি গঠনের সময় সুবহানকে আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে তিনি নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হন।

১৯৬২ থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন সুবহান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আমজাদ হোসেনের কাছে তিনি পরাজিত হন।     

বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম দমনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে শান্তি কমিটি গঠন করা হলে পাবনা জেলা কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পান সুবহান। পরে তিনি ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন।

তার নেতৃত্বেই পাবনা জেলার বিভিন্ন থানায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। এসব বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পাবনার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সুবহান হত্যা, লুটপাট, অপহরণ, নির্যাতনের মতো অপরাধ ঘটান বলে এ মামলার সাক্ষীদের বক্তব্যে উঠে আসে।

মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী কোরবান আলী কাঠগড়ায় সুবহানকে দেখিয়ে বলেন, তিনি নিজে পিস্তল হাতে গ্রামবাসীদের ধরে এনে গুলি করেন এবং পাক সেনাদের গুলি করতে বলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নামের তালিকা করে সুবহান পাকিস্তানি সেনাদের কাছে সরবরাহ করতেন বলেও শুনানিতে ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ইয়াহিয়া সরকারের পতন দেখে জামায়াতগুরু গোলাম আযমের সঙ্গে সুবহানও পাকিস্তানে চলে যান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি দেশে ফেরেন এবং পরে সংসদ সদস্য হন।

‘এ কি নিষ্ঠুরতা!’

রায়ের জন্য বুধবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় আবদুস সুবহানকে।  প্রায় দুই ঘণ্টা ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখার পর সুবহানকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালত কক্ষের কাঠড়গায়। ১১টায় এজলাসে এসে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক আসন গ্রহণ করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, “আব্দুস সুবহান ও তার সহযোগীরা ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে সাধারণ মানুষদের টেনে হিঁচড়ে বের করে তলোয়ারের আঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করেন। একি নিষ্ঠুরতা! অভিযুক্ত আব্দুস সুবহানের এ বর্বরতা বিশ্বাস করা কঠিন।”

এ মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী তহুরুল আলম মোল্লা শুনানিতে আদালতকে জানিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈশ্বরদী জামে মসজিদের পাশে রেলওয়ের কয়লার ডিপোতে তার চোখের সামনে তার বাবাকে নিজে হাতে ছুরি মারেন সুবহান। ওই মসজিদে আশ্রয় নেওয়া ১৯ জন নিরস্ত্র মানুষকে সুবহানের উপস্থিতিতে একই জায়গায় নিয়ে হত্যা করা হয়।

একজন বাঙালি মুসলমান হয়ে আব্দুস সুবহান নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে ‘চূড়ান্ত বর্বরতা’ দেখিয়েছেন, তা কোন ধরনের মানবতার সংজ্ঞায় পড়ে- সে প্রশ্ন রাখেন বিচারক।

রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর পাবনা শাখার আমির হিসেবে সুবহান তার দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান। এতে প্রমাণিত হয় জামায়াতে ইসলামী একটি ‘সন্ত্রাসী দল’।

রায় ঘোষণা চলাকালে বেশিরভাগ সময় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন সুবহান, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে এক সময় সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। 

তবে রায়ের শেষ অংশে সাজা ঘোষণা শুরু হলে মাথা উঠিয়ে চোখ বড় করে সাজা ঘোষণা শুনতে থাকেন সুবহান। মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ার পরও তাকে নিশ্চুপ দেখা যায়।

সাজা ঘোষণার পরপরই বিচারকরা এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর সুবহানের হাত ধরে আদালত কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। পরে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। 

মামলার দিনপঞ্জি

২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল সুবহানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেন প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও  মো. নূর হোসাইন। পরের বছর ১৫ সেপ্টেম্বর জামায়াতের এই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় প্রসিকিউশনের তদন্ত দল।

এরই মধ্যে ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজা থেকে সুবহানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

আট ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে নয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুবহানের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল-১। কিন্তু সাক্ষ্য শুরুর আগেই গতবছর ২৭ মার্চ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে স্থানান্তর করা হয় ট্রাইব্যুনাল-২ এ।

প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল শুরু হয় মামলার  শুনানি।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও মো. নূর হোসাইনসহ ৩১ জন।

অন্যদিকে সুবহানের পক্ষে তিনজনের নাম দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তার আইনজীবীরা কোনো সাফাই সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে গতবছর ৪ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন বিচারক।

ষোড়শ রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।  গতবছর ৩ নভেম্বর আপিলের রায়েও তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে ২০১৩ সালের ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গতবছর ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

ওই বছর ১ অক্টোবর  সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারা দুজনই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গতবছর ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।

দশম রায় আসে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর। জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।  তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

একাদশ রায়ে গতবছর ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে।

এরপর ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।

২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়।

গতবছর ২৩ ডিসেম্বর এরশাদ আমলের প্রতিমন্ত্রী ও একাত্তরে হবিগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে আদালত সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয়।

আর সর্বশেষ গতবছর ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির আদেশ আসে।

 

[এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আজিজ হাসান, কামাল তালুকদার, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম,  হাসিবা আলী বর্ণা ও মাহমুদ মুরাদ।]