বিরোধী জোটের টানা অবরোধের মধ্যে প্রতিদিনই বাড়ছে আগুনে পোড়া মানুষের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে আর্তচিৎকার, বাঁচার আকুতি ও স্বজনদের হাহাকার।
Published : 25 Jan 2015, 12:25 AM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পোড়া মানুষগুলোর এই বেঁচে থাকার আকুতিতে কেউ কেউ বললেন নিজেদের অসোয়াস্তির কথা।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, “৫ জানুয়ারির পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন গণপরিবহনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় তাদের কাছে ৭৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের ২১ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছুটি দেওয়া হয়েছে। ৫২ জন এখনও ভর্তি রয়েছেন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন পাঁচ জন।”
শনিবার বার্ন ইউনিট ঘুরে দেখা গেছে, দ্বিতীয় তলার ২০১ নম্বর ওয়ার্ডে গাজীপুরের বাসিন্দা পারভীন বেগম স্বামীর পাশে বসে চোখের জল ফেলছেন। দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে স্বামীর জন্য জীবন ভিক্ষা চেয়ে কান্নাকাটি করছেন তিনি।
শুক্রবার রাতে রাজধানী যাত্রাবাড়ী থানার মোল্লার ব্রিজ এলাকায় একটি বাসে দুর্বৃত্তরা পেট্রোল বোমা ছুড়লে দগ্ধ হয়ে ২৭ জন বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন।
পারভীনের স্বামী মো. জমির শেখ তাদেরই একজন। তার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে।
জমির গাজীপুরে কৃষিকাজ করেন। এলাকায় কাজ না থাকলে ঢাকায় এসে মগবাজারে একটি গ্যারেজে রাতে থাকেন। সকালে রিকশা চালান। সপ্তাহের আয় নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে।
জমিরের দুই হাত ব্যান্ডেজ মোড়ানো। ঝলসানো পুরো মুখে ওষুধ মাখা। চোখ মেলতে না পারলেও ব্যান্ডেজ পেঁচানো দুই হাত সামান্য উচু করে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন জমির। কোনো কথাও বলতে পারছেন না তিনি।
পারভীন বেগম বলেন, “আমি টেকা চাই না। পয়সা চাই না। আল্লাহর কাছে স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাই। উনার কিছু হইলে আমাগো পোলাপানগো কি হইবো? আমি কই যামু? আল্লাহ তুমি তার জীবন ভিক্ষা দাও। আমারে কোন পরীক্ষায় ফালাইলা তুমি আল্লাহ?”
দুই তলার বারান্দায় শুয়ে আছেন আগুনে পোড়া বাসটির আরেক যাত্রী সালাউদ্দিন পলাশ (৩০)। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের বাসিন্দা পলাশ বসুন্ধরা সিটির ‘আমিন সুজ’ নামে একটি জুতার দোকানের কর্মচারী।
বৃদ্ধ বাবা মা, দুই সন্তান আরিফ (৬) ও ইভা (৩) এবং স্ত্রীকে নিয়ে পলাশ নারায়ণগঞ্জ থাকতেন। প্রতিদিন সেখান থেকেই বাসে আসতেন ঢাকা।
নাসরিন বলেন, “দোকানের কাম শেষে পোলার জন্য ক্রিকেট ব্যাট কিনা বাসে বাড়ি ফিরতেছিলেন তিনি। কিন্তু বাসে আগুন লাগায় জানালার কাচ ভাইঙ্গা সে বাইর হইছিল। হাত, মুখের ২৫ ভাগ পুইড়া গেছে। বাম পাও ভাইঙা গেছে।”
চিকিৎসার খরচ বহনে অপারগ নাসরিনের আর্তি একটু সহযোগিতা, ভালো চিকিৎসা।
তখনও হাসপাতালে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে শিশু ইভা। বাবা কাছে যেতে ইশারা করলেও ভয়ে বাবার কাছে যাচ্ছিল না শিশু ইভা।
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী ড. সামন্তলাল সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দগ্ধদের মধ্যে ছয় জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।”
তার স্ত্রী উর্মি বলেন, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে তাদের বাসা।
“শুক্রবার রাতে দোকানের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে পেট্রোল বোমায় আক্রান্ত হয় সালাউদ্দিন। প্রথমে চিকিৎসকরা বলেছিল অন্যদের চেয়ে তার শারীরিক অবস্থা ভালো। তবে সময় যতো পার হচ্ছে মনে হচ্ছে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সকালে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।”
“ভাই, হাসপাতালে আইসা কারো থেইকা আর্থিক সহায়তা পাই না। উল্টা উনার চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা আনসিলাম। তাও সকালে হাসপাতলের নিচ থিকা চুরি হইসে,” বলেই কেঁদে ফেলেন উর্মি।
একই ওয়ার্ডে গুরুতর দগ্ধ হয়ে মো. খোকন (২০ ভাগ পুড়ে গেছে), মো. মাসুদ (৩৫ ভাগ পুড়ে গেছে) ও নাটোরের পাটুল গ্রামের বাসিন্দা নূর আলমকে ৪৬ ভাগ দগ্ধ শরীর নিয়ে অনেকটা অচেতন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সদের দেখা গেছে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে। চিকিৎসকদের দলবেঁধে আগুনে দগ্ধদের খোঁজখবর নিতেও দেখা যায়।
আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, “যাত্রাবাড়ীতে বাসে পেট্রল বোমা ছোড়ায় যারা দগ্ধ হয়েছেন তাদের বিভিন্ন জনের ১২ থেকে ৪৬ ভাগ পর্যন্ত আগুনে দগ্ধ হয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দিতে চেষ্টা করা হচ্ছে।”