ট্যাংকার দুর্ঘটনার পর সুন্দরবনের শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তেল। পানির ওপর তেল ভাসতে দেখা যাচ্ছে বনের ভেতরের খালগুলোতেও।
Published : 10 Dec 2014, 11:00 PM
“যতদূর দেখা যায়, শুধু তেল ভাসতে দেখা যায়,” দুর্ঘটনার একদিন পর এই বর্ণনা সুন্দরবন বিভাগের খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক কার্ত্তিক চন্দ্র সরকারের।
মঙ্গলবার ভোরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর বুধবার এই বিবরণ দিয়েছেন তিনি।
সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরইমধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তাদের হিসাব। আর তা যে এই বিশ্বঐতিহ্যের জন্য বিপর্যয় আনসতে পারে, তার আশঙ্কা শুরুতেই করেছিলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
শেলা নদীর মৃগমারী, আন্ধারমানিক, তাম্বুলবুনিয়া, হরিণটানা, শুয়ারমারা, জিউধরা, ধানসাগর, নন্দবালা, হারবাড়িয়া, চাঁদপাই স্টেশন কার্যালয়, মরাপশুর, জংড়া, করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র, ঢাংমারী, ঘাঘড়ামারী ও লাউডোব এলাকায় তেল ভাসছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
নিজেদের অভয়াশ্রম শেলা নদীর জয়মনি এলাকায় একটু পর পর ডলফিন লাফিয়ে উঠত। তবে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর মঙ্গলবার বিকাল থেকে আর কোনো ডলফিন উঠতে দেখা যাচ্ছে না বলে স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে শেলা নদীর শাখা খাল জয়মনি, মৃগমারী, মোরগমারী, বাদামতলা, খড়মা, উলুবুনিয়া, বটতলা, তেঁতুলবুনিয়া, ভাইজোড়া, হেতালমারী ও জিন্নাতের খালে জ্বালানি তেল ভাসতে দেখা গেছে।
বন কর্মকর্তা কার্ত্তিক জানান, সুন্দরবনের ওই সব এলাকায় সুন্দরী গাছ বেশি আছে। শেলা নদী সংলগ্ন বনের সুন্দরী, কেওড়া, বাইনসহ গুল্ম জাতীয় গাছের পাতায় তেলের আবরণ লেগে রয়েছে। কোথাও কোথাও জোয়ারের পানি বনভূমিতে উঠে বনের গাছের শ্বাসমূলে লেগে আছে। শেলা নদীর চরে তেল লেগে মাটির ওপর কালচে আস্তরণ পড়েছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের জয়মনি গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার শেলা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বুধবার এই গ্রামের জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে নামেনি।
তেলের কারণে নদীতে আগের মতো মাছ না পাওয়ার আশঙ্কা করেন তিনি।
আরেক জেলে রহমান মিয়া (৫৪) বলেন, “নদীর জয়মনি এলাকায় ডলফিনের (শুশক) অভয়ারণ্য। এখানে সব সময় ডলফিন লাফাতে থাকে। তাই সুন্দরবন দেখতে পর্যটকরা এখানে প্রতিনিয়ত ভিড় করে থাকেন।
“এই নদীতে তেল ভাসার পর থেকে ডলফিনের কোনো লাফালাফি নেই। তেলের কারণে হয় মরে গেছে অথবা দূরে কোথাও সরে গেছে। আরও কয়েকদিন গেলে পরে তা বোঝা যাবে।”
মঙ্গলবার বিকালের পর থেকে তিনি কোনো ডলফিন নদীতে উঠতে দেখেননি বলে জানান রহমান।
চিলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলামও তার কথায় সায় দেন।
“নদীতে তেল ভাসার কারণে এখানে আজ একটি ডলফিনও লাফাতে দেখা যায়নি,” বলেন তিনি।
জয়মনি গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব জেলে রহমান হাওলাদার বলেন, “আমি কখনও নদীতে এইভাবে তেল ভাসতে দেখিনি। মঙ্গলবার দুপুরে শেলা নদীর জোয়ারের পানিতে জয়মনি এলাকায় অল্প কিছু তেল ভাসতে দেখি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে নদীতে তেলের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
“আজ সকালে নদীর কিনারে এসে দেখি শেলা নদীর চরে তেলের স্তূপ লেগে আছে। ওই তেলে মাটির রং কালো ও লালচে হয়ে গেছে।”
তেল ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে বন সংরক্ষক কার্ত্তিক চন্দ্র সরকার বলেন, “এই তেলের ক্ষতিকর প্রভাব এখনই বোঝা যাবে না। একটু সময় লাগবে।
“এই তেলের কারণে সুন্দরবনের গাছপালা আস্তে আস্তে শুকিয়ে মারা পর্যন্ত যেতে পারে। সুন্দরবনের নদী-খালে অন্তত তিনশ প্রজাতির মাছের বিচরণ রয়েছে। ছোট প্রজাতির কিছু মাছ এরইমধ্যে মরতে শুরু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নদীর পাঙ্গাস ও পারশে মাছ।”
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হুসাঈন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের নদী-খালে তেল ছড়িয়ে পড়ায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে ৩১ কিলোমিটার জুড়ে থাকা ডলফিন অভয়াশ্রম। এর বড় অংশটিই শেলা নদীতে।
নদী থেকে তেল দ্রুত অপসারণ করা না গেলে বিরল প্রজাতির ডলফিনের এই অভয়াশ্রম রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।