ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে বিআরটিএর অভিযানে যখন সক্রিয় পুলিশ, তখন গাজীপুরেই এই বাহিনীর সদস্যদের দেখা যাচ্ছে ‘আনফিট’ সব গাড়িতে।
Published : 15 Nov 2014, 08:31 PM
লেগুনার মতো এসব বাহন খোদ পুলিশের নাকের ডগায় তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যেগুলো পুলিশের পাশাপাশি গণপরিবহন হিসেবেও সড়কে রয়েছে।
আর এসব যান ব্যবহারের বিষয়ে নিজেদের গাড়ি সঙ্কটের কথা তুলে ধরে ধরলেন জয়দেবপুরসহ থানাগুলোর পুলিশ কর্মকর্তারা।
ফিটনেসবিহীন গাড়ি সনাক্তে গত সপ্তাহ থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অভিযান চলছে, এতে পুলিশ সহযোগিতা করছে।
এসব অভিযানে ‘আনফিট’ গাড়ি জব্দ করা হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে লাইসেন্সবিহীন গাড়ির মালিকদের।
গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় অনেক দিন ধরেই ভাড়া করা লেগুনা বা টেম্পু ব্যবহার করছে পুলিশ, যে যানগুলো এই জেলাতেই অনুমোদনহীনভাবেই তৈরি হয়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সালনা রেলওভার ব্রিজের দক্ষিণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমপাশে কয়েকটি ওয়ার্কশপে বানানো হচ্ছে এসব লেগুনা।
ওয়ার্কশপের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমমূল্যে মেয়াদোত্তীর্ণ বা আনফিট মাইক্রোবাস কিনে তা কেটে পেছনে পছন্দ অনুযায়ী ‘বডি’ সংযোজন করে বানানো হচ্ছে ‘লেগুনা’ নামের এসব যান।
গাজীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. মাসুদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়াদোত্তীর্ণ মাইক্রোবাস কেটে লেগুনা বানানোর কোনো বৈধতা নেই। আর ভাল গাড়ির যে কোনো ধরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের বেলায়ও বিআরটিএর অনুমতি প্রয়োজন হয়।”
অননুমোদিত এই লেগুনাগুলোই জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন থানার পুলিশকে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
প্রতিদিন পুলিশকে ৭০-৮০টি গাড়ি সরবরাহ করা হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান গাজীপুরের পরিবহন নেতা মো. সুলতান উদ্দিন সরকার। তবে এগুলো ‘আনফিট’ নয় বলে তার দাবি।
‘আনফিট’ এই গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে জয়দেবপুর থানার ওসি খন্দকার মো. রেজাউল করিম রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফিট-আনফিট বুঝি না, আমাদের এখন গাড়ি সঙ্কট, তাই ওইগুলোই ব্যবহার করছি।”
জয়দেবপুর থানায় দুটি পিকআপভ্যান রয়েছে, এর মধ্যে একটি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা ও ভিআইপিসহ সব ডিউটির কাজ বলে জানান ওসি।
“পুলিশের ডিউটির জন্যে এ থানায় ১২-১৪টি গাড়ি দরকার। কিন্তু তা না থাকায় আমাদের প্রতিদিন বাইরে থেকে ১০-১২টি টেম্পু বা লেগুনা এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে।”
ওসি রেজা স্বীকার করেন, এসব গাড়ি নিয়ে আসামি ধরতে গিয়ে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে আসামি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
গাড়ি সঙ্কটের কথা জানালেন কাপাসিয়া থানার ওসি মো. আহসান উল্লাহ ও টঙ্গী থানার ওসি কাজী ইসমাইল হোসেনও।
কালীগঞ্জ থানার ওসি মো. নাজমুল হক ভুইয়াও বলেন, তাদের তিনটি গাড়ির প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র একটি পিকআপ।
কালিয়াকৈর থানার ওসি মো.ওমর ফারুক বলেন, ১২টি গাড়ির চাহিদার বিপরীতে তাদের আছে দুটি পিকআপ।
শ্রীপুর থানার ওসি মোহসীন উল কাদির বলেন, “মাত্র দুইটি পিকআপে হয় না বলে বাইরে থেকেই গাড়ি রিক্যুইজিশন করতে হয়।”
পুরনো গাড়ি কেটে নতুন গাড়ি
সালনায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমপাশের কয়েকটি ওয়ার্কশপে পুরনো গাড়ি কেটে নতুন গাড়ি বানাতে দেখা গেলেও সংশ্লিষ্টরা কেউ এই কাজের অনুমোদন দেখাতে পারেননি।
ওই এলাকার বাসিন্দা ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক শ্রেণির পরিবহন ব্যবসায়ী কম দামে মেয়াদোত্তীর্ণ মাইক্রোবাস কিনে তা কেটে তাতে পছন্দ অনুযায়ী ‘বডি’ সংযোজন করে এসব লেগুনা বানায়।
“এসব লেগুনার কোনোটিতে প্লেট নম্বর নেই, আবার থাকলেও তা সঠিক নয় কিংবা পরিবর্তিত গাড়িতে আগের মাইক্রোর নম্বরই ব্যবহার করা হচ্ছে।”
একটি ওয়ার্কশপের মালিক মো. জুয়েল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ফিটনেসবিহীন মাইক্রোবাস বা পিকআপ ভ্যান দেড়-আড়াই লাখ টাকায় কিনে কয়েকজন নিয়ে আসে।
“আমরা ওইসব গাড়ির বডি ফিট ও ইঞ্জিন মেরামত করে লেগুনা বানাই,” বলেন তিনি।
একটি মাইক্রোবাস কেটে ৪০-৫০ হাজার টাকা এবং পিকআপ ভ্যানকে লেগুনা বানাতে ৭০-৮০ হাজার টাকা নেন বলে জুয়েল জানান।
তবে এ গাড়ি বানানোর বৈধতার ব্যাপারে কাগজপত্র দেখতে চাইলে তা দেখাতে পারেননি জুয়েল।
এসব গাড়ির অধিকাংশই চলছে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইন্সেধারী অপরিণত চালক দিয়ে, যার প্রমাণ মেলে কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলেও।
চান্দনা-চৌরাস্তা থেকে ভাওয়াল মির্জাপুর রুটে চলাচলকারী লেগুনা চালক সেন্টু মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই ১০ বছর ধরে লেগুনা চালাচ্ছেন তিনি।
৩ লাখ টাকায় মাইক্রোবাস কিনে এনে সালনা এলাকায় ওয়ার্কশপ থেকে বডি লাগাতে সেন্টু মিয়ার খরচ পড়েছে ৫ লাখ টাকা। এখন সেই গাড়ি পুলিশকেও ভাড়া দেন তিনি।
স্থানীয় পরিবহন নেতাদের চাঁদা দেন জানিয়ে সেন্টু বলেন, “উনারাই ওসি-এসপি মেনটেইন করেন। ফলে আমাদের সড়কে চলতে কোনো অসুবিধা হয় না। এছাড়া আমার এ গাড়ি পুলিশ ডিউটিও করে। তাই কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও কিছুই বলে না পুলিশ।”
তবে জয়দেবপুর থানার ওসি রেজা এসব গাড়ি চালাতে দিয়ে পরিবহন নেতাদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পুলিশের কথা বলে লেগুনা চালকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন শ্রমিক নেতা সুলতান সরকারও।