ঢাকার রাস্তায় মিটার চালু অবস্থায় ঝাঁকে ঝাঁকে অটোরিকশা দেখে প্রথম দৃষ্টিতে যে কারো মনে হতে পারে এই যান বুঝি ‘সহজলভ্য’। তবে প্রয়োজনে ঘাম ঝরিয়েও যখন মেলে না তখন বোঝা যায় সাধারণ মানুষ কতোটা অসহায়। মিটারে তো দূরে থাক, যেখানেই যাবেন হাঁকা হবে ‘সর্বনিম্ন ২০০ টাকা’।
Published : 04 Nov 2014, 12:35 PM
রাজধানীর রাজপথে এ চিত্র প্রতিদিনের।
যাত্রীদের অভিযোগের অন্ত নেই সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালকদের বিরুদ্ধে। তবে ব্যবস্থা বা সমাধানের প্রসঙ্গ এলেই আঙুল যাচ্ছে অন্য দিকে, প্রশ্ন উঠেছে- তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থা কেন নির্বিকার!
গত বুধবার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে অটোরিকশা খুঁজতে দেখা গেল লুৎফুল হায়াৎকে, যাবেন মতিঝিল। অফিসের সময় হয়ে গেছে তাই বারবার মোবাইল ফোন বের করে সময় দেখে নিচ্ছিলেন। ‘মিটার থেকে বাড়িয়ে দেব’, ‘আড়াইশ দেব’- নানা কথা বলেও মন গলাতে পারছিলেন না চালকদের।
উত্তর এলো ‘ভাই, অফিস টাইমে ওইখানে অনেক জ্যাম থাকে, যামু না’, কেউ আবার বললেন- ‘সাড়ে তিনশ দিলে আসেন’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষোভ ঝরলো লুৎফুলের কণ্ঠে: “এমনিতেই বাসে ওঠা দায়। দেখছেনই তো একটা অটোরিকশাও মিটারে যেতে চায় না। বেশি করে ভাড়া দিতে চাইলাম, তাও যাবে না। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায়? কেউ কি দেখার নেই?”
শুধু লুৎফুল হায়াৎ নন, এ অভিযোগ ঢাকার রাস্তার সব যাত্রীর কণ্ঠেই।
বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মিতা হক বললেন, “গত এক ঘণ্টা ধরে সিএনজি খুঁজছি। দেখতেই পাচ্ছেন এখানে কতগুলো সিএনজি। কিন্তু কেউ যাবে না। যত টাকা চাইবে তত টাকা দিলেই কেবল তারা রাজি।”
“মিটারের কথা বললে উল্টো শুনতে হয় ঢাকায় কি নতুন আসছেন নাকি?”, বলেন মিতা।
ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই নারীর প্রশ্ন: “তাহলে কি সিএনজি চালকদের কাছে ঢাকার বাসিন্দা হওয়ার সার্টিফিকেট দিতে হবে। এমনিতেই সবক্ষেত্রে আমরা সাধারণরা জিম্মি। এখন সিএনজি চালকদের দৌরাত্মে খুব অসহায় মনে হয়।”
মিটারে না যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সব চালকের মুখেই এক কথা, সিএনজি মালিকের জমার টাকা…।
মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে অটোরিকশা চালক মো. বাবুল বলেন, “আমি এক বেলা গাড়ি চালাই, আমাকে এর জন্য ৭০০ টাকা জমা দিতে হয়। অফিসের সময়, এ সময় জ্যাম বেশি, মিটারে গেলে পোষাবে না। এজন্য চুক্তিতে যাব।”
পাশে দাঁড়ানো মিতা হক তখন বলে উঠেন, “এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেখানেই যান না কেন, ভাড়া চাইবে ২০০ টাকা। এর নিচে কোন ভাড়া নেই। তার উপরে সিএনজিতে বসার পরে চালকরা বলবে, সার্জেন্ট ধরলে মিটারের কথা বইলেন।”
বাংলাদেশ গণপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে ঢাকায় রাস্তায় চলাচলের সনদ রয়েছে আট হাজার একটি সিএনজি অটোরিকশার। আর চালকদের হিসেবে এ সংখ্যা আরও কম।
চালকদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা জেলা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেনের কাছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অটোরিকশাগুলো যে মিটারে চলে না এর জন্য সরকারের পলিসির ভুল রয়েছে। যখন এগুলো রাস্তায় নামানো হয়, সে সময় এগুলোর ইকোনমিক লাইফ (আয়ুস্কাল) ছিল ৯ বছর। তখন সরকার জমা নির্ধারণ করেছিল ৬শ টাকা।”
“মালিকরা এখন দু’বেলা ৭শ টাকা করে মোট ১৪শ টাকায় দুজন চালকের কাছে অটো দেন। বেশিরভাগ দিনই দেখা যায় মালিকের জমা উঠে আসে না। আর বিআরটিএ বা সরকার চালকদের উপরে বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও কখনো কোন মালিকের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি।”
মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অটোরিকশাগুলোর ‘রিপ্লেসমেন্ট‘ না হওয়ায় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি তার।
তবে মালিক সংগঠনের কথা ঠিক তার উল্টো। তারা অটোরিকশার ‘অরাজকতার’ জন্য চালকদেরই দায়ী করেছেন।
ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমএইচ ইকবাল মিরাজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চালকরা সব সময়ই বলেন তাদের জমার টাকা উঠে আসে না। অনেক চালক স্বল্প দুরত্বে যেতে রাজি হয় না। বেশিরভাগ সময় গাড়ি যেহেতু চালকের হাতে থাকে এতে আমাদের (মালিকদের) কিছু করার থাকে না।”
জমা বেশি নেওয়ার বিষয়ে চালকদের অভিযোগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যদি জমা প্রতিদিন ৩শ টাকা করেও নেওয়া হয় তারপরও তারা এমনটা করবে। এটা তাদের একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। যেহেতু বাজারে প্রতিযোগিতা নেই এ কারণে তারা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে থাকেন।”
প্রয়োজন অনুসারে রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশা চালানোর অনুমোদন দিলে ‘চালকদের জুলুম’ থেকে যাত্রীরা পরিত্রাণ পাবে বলে মনে করেন তিনি।
জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন বলেন, “সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চালকদের মালিকানায় চলাচলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ৫ হাজার সিএনজি নামলে আশা করা যায় যাত্রীদের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমবে।”
“ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থার কোনো পরিকল্পনা নেই। একটি শহরে লোকজনকে বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের জন্য বাস থাকা উচিত। এখানে তা নেই। নেই পর্যাপ্ত বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থাও।”
পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু ও কলকাতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এ শহরগুলোতে বিকল্প পরিবহন হিসেবে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। ঢাকায় যে পরিমাণ সিএনজি চলাচল করে এর থেকে কয়েকগুণ বেশি থাকা উচিত।”
সিএনজি অটোরিক্সার কারণে ভোগান্তির বিষয়ে বিআরটিএ পরিচালক (প্রশাসন) মো. মশিয়ার রহমান বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় রাস্তায় আমাদের তিনটি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে থাকি। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না।”
“চালকরা বিভিন্ন সময় মালিকদের বিষয়ে অভিযোগ তোলেন। কিন্তু যখন অভিযান চলে তখন কেউ কোনো কথা বলতে চান না। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় করেও অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন।”
মিটারে যেতে না চাওয়া অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় যাত্রীদের ‘অসহযোগিতা’ পাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
বায়ু দূষণের হাত থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে চলতি শতকের শুরুতে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা তুলে দিয়ে রাজধানীতে চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘বেবি ট্যাক্সি’ নামে পরিচিত হলুদ রঙের অটোরিকশাগুলোকে বিদায় করে ২০০২ সালে রাস্তায় নামে সবুজ রঙের সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
ইঞ্জিনের ‘ইকোনোমিক লাইফ’ হিসাব করে সেই সময় ৯ বছরের জন্য অটোরিকশার লাইসেন্স দেওয়া হলেও মালিক ও চালকদের দাবির কারণে আরো দুই বছর বাড়ানো হয় এর মেয়াদ।
বর্তমানে সবুজ ও ছাই রঙের অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। সবুজ সিএনজি বাণিজ্যিক আর ছাইগুলো ব্যক্তিগত।