দ্বিতীয় ফাঁসির রায়ে নিজামীর চোখে বিহ্বল দৃষ্টি 

চার দশক আগে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতি দেখেছে তার নৃশংসতা, এক দশক আগে দেখেছে তার মন্ত্রিত্বের দাপট, যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ সাজার আদেশের পর সেই মতিউর রহমান নিজামীর চোখে দেখা গেল বিহ্বল দৃষ্টি। 

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2014, 02:16 PM
Updated : 29 Oct 2014, 02:57 PM

বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার জামায়াত আমির নিজামীকে প্রাণদণ্ড দেয়। 

৭১ বছর বয়সী নিজামী দণ্ড শুনে উঠে দাঁড়াননি, কোনো কথাও বলেননি। দৃশ্যত বিমর্ষ এই জামায়াত নেতাকে শুধু বিচারকের দিকে তাকাতে দেখা যায়।

ট্রাইব্যুনাল রায়ের দিন ঘোষণার পর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া নিজামীকে মঙ্গলবার রাতেই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বুধবার সকাল ৯টা ১৯ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যান তাকে নিয়ে পুরাতন হাই কোর্ট এলাকায় ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। 

প্রিজন ভ্যান থেকে পায়ে হেঁটে নিজামী ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় পৌঁছান। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় তাকে সেখানে অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ি থেকে তাকে দেখাও যায়।

সাদা পাঞ্জাবির ওপর কফি রংয়ের কোটি পরিহিত জামায়াত আমিরের মাথায় এ সময় ছিল একটি জিন্নাহ টুপি। কখনো গালে হাত দিয়ে, কখনো আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়।

হাজতখানা থেকে নিজামীকে আদালত কক্ষে নেওয়া হয় বেলা ১১টায়। বসতে দেওয়া হয় কক্ষের পেছন দিকে আসামির কাঠগড়ায় রাখা চেয়ারে।

চেয়ারে বসেই হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকান নিজামী। কয়েক মিনিটের মধ্যে এজলাসে আসেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর তিন বিচারক এম ইনায়েতুর রহিম, জাহাঙ্গীর হোসেন ও মো. আনোয়ারুল হক।

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম রায়ের আগে প্রাথমিক বক্তব্য শুরু করলে নিজামী মাথা থেকে টুপি খুলে রেখে চেয়ারের ডান হাতলে ভর দিয়ে পেছন দিকে শরীর এলিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তার চোখও বন্ধ হয়ে যায়।

২০৪ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসারের ভূমিকা ও অভিযোগ পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এরপর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন পড়েন রায়ের পর্যবেক্ষণ।

প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা রায় পাঠের প্রায় পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে এভাবেই কাটান একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চেয়ারম্যান এবং জামায়াতের বর্তমান আমির নিজামী। পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত কুখ্যাত আল বদর বাহিনীরও প্রধান ছিলেন তিনি।

রায়ে বলা হয়, “এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সক্রিয়ভাবে যিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাকে এই প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

“আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই অভিযুক্তকে মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া একটা বড় ধরনের ভুল (ব্লান্ডার) ছিল। পাশাপাশি এটা ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ছিল সুস্পষ্ট চপেটাঘাত।”

আদালত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে সাজা কার্যকর করার আদেশ দেওয়ার পর চোখ মেলে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে দেখা যায় গত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী নিজামীকে। এ সময় চেয়ার থেকে মাথা তুললেও জোরালো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি তার মধ্যে।

বরাবরের মতো এবারও কাঠগড়া ঘিরে ছিল পুলিশ। রায় শেষ হওয়ার পর তাকে ঘিরে ধরে নিচে নিয়ে হাজতখানায় যান পুলিশ সদস্যরা।

এ সময় তাকে বাসা থেকে পাঠানো খাবারও খেতে দেওয়া হয়।  তাজুল ইসলামসহ দুই আইনজীবী এ সময় তার সঙ্গে দেখা করেন।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেলা ৩টার দিকে হাজতখানা থেকে বের করে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয় নিজামীকে। তখনো তাকে দেখা যায় খানিকটা বিমর্ষ, খানিকটা উদাস; চোখে সেই বিহ্বল দৃষ্টি।

এর আগে রায়ের পর সবচেয়ে বড় গলায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী। রায়ের পর তিনি বলেছিলেন, এটা বিচারকদের ‘শপথের বিবেচনা দ্বারা’ দেয়া রায় নয়। ‘শাহবাগের আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত’ রায়।

ওই বক্তব্যের জন্য আদালতের দর্শক সারি থেকে সাঈদীকে উদ্দেশ্য করে কয়েকজন বলে ওঠেন- ‘তুই রাজাকার’।