নাটোরে দুই বাসের সংঘর্ষে নিহত ৩৪

নাটোরের বড়াইগ্রামে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে যাত্রীবাহী দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাটোর ও রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2014, 10:30 AM
Updated : 20 Oct 2014, 10:30 AM

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সোমবার বিকাল সোয়া ৪টায় বড়াইগ্রাম উপজেলায় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে রেজির মোড় এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

দুর্ঘটনা কবলিত কেয়া পরিবহনের বাসটি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিল, অথৈ পরিবহনের অন্য বাসটি নাটোর শহর থেকে যাচ্ছিল গুরুদাসপুর উপজেলা সদরে।

দুর্ঘটনায় আহত হয়ে স্থানীয় পাটোয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “অন্য একটা গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে কেয়া পরিবহনের বাসটি আমাদের বাসটিকে ধাক্কা দেয়। আমরা চারিদিকে ছিটকে পড়ি।”

রেজির মোড়ের বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, কেয়া পরিবহনের বাসটি একটি ট্রাককে অতিক্রম করতে গিয়ে অথৈ পরিবহনের বাসকে সামনে থেকে ধাক্কা দেয়।

সংঘর্ষে দুটো বাসেরই সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। অথৈ পরিবহনের বাসটি রাস্তার ওপর উল্টে পড়ে এবং কেয়া পরিবহনের বাসটি রাস্তার পাশের ঢালে পড়ে যায়।

মহাসড়কে এই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার বিভিন্ন রকম তথ্যের ফলে বিভ্রান্তি দেখা যায়।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক ইকবাল বাহার সাংবাদিকদের বলেন, বনপাড়ার এই দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনায় আহত কয়েকজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল।

সেখানে সন্ধ্যায় নাটোরের গুরুদাসপুরের রেজাউল ইসলাম (২৮) নামে একজনের মৃত্যু হয় বলে রামেক পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই এমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

ডিআইজি ৩২ জনের মৃত্যুর খবর জানানোর দেড় ঘণ্টা পর রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আরও দুজনের মৃত্যু হয়। তাদের নাম আজাদুল বারী (৩০) ও আয়নাল হক (৪০) বলে এএসআই এমরান জানান।

তার আগে বিকালে বড়াইগ্রাম থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান।

দুর্ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত বিভিন্নজনকে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়, এদের কেউ কেউ মারা যান। ফলে নিহতের সংখ্যা নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নানা তথ্য আসে।

নাটোরের বিভিন্ন হাসপাতালে থাকা বেশিরভাগ লাশ পরে বনপাড়া হাইওয়ে থানায় আনা হয়। সেখানে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয় বলে নাটোরের পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন। তবে কয়েকটি লাশ হাসপাতাল থেকেই স্বজনরা গ্রহণ করেন।

বনপাড়া হাইওয়ে থানার ওসি ফুয়াদ রুহানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার থানায় ২৭টি লাশ ছিল। এগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।এর মধ্যে দুই নারী ও এক শিশুর লাশ ছিল।”

কেয়া পরিবহনের এক যাত্রীর লাশ রাত ৮টা নাগাদও থানায় ছিল। নিহত এই ব্যক্তির বাড়ি চট্টগ্রামে বলে পুলিশ জানায়।

নিহতদের মধ্যে উভয় বাসের চালক ও তাদের সহকারীরা রয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই গুরুদাসপুরগামী অথৈ পরিবহনের যাত্রী। 

নিহতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন-  আরিফ হোসেন (৪৫),  আব্দুর রহমান (৫৫), শরিফ উদ্দিন (৪৫), আলাল হোসেন (৫০), আলম শেখ (৩৫), রুবেল হোসেন (৫৫), জান মোহাম্মদ মোল্লা (৫৬), এবাদ আলী (৬৫), আতাহার হোসেন (৪৫), আয়নাল হোসেন (৫৫), কৃষ্ণপদ সরকার (৪২), রহমত আলী (৪৬), শৈলেন তিলক (৪৫), সেবা খাতুন (৮), বেলাল হোসেন  (৪৭), লাবু হোসেন (৩০), তোফাজ্জল হোসেন (৪০), কহির উদ্দিন (৬০), সোহরাব হোসেন (৫০), কিসমত উল্লাহ (৩৫), বাবু শেখ (৪৫), কুদ্দুস আলী (৬৫), হাফিজুর রহমান (৫৮), রেজাউল করিম (৩২)।

দুর্ঘটনায় দুই বাসেরই অধিকাংশ যাত্রী কম-বেশি আহত হন। আহতদের রাজশাহী মেডিকেল ছাড়াও বড়াইগ্রামের আমেনা হাসপাতাল, পাটোয়ারি হাসপাতাল, জয়নব হাসপাতাল, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিহতদের ২৯ জনই গুরুদাসপুরগামী বাসের যাত্রী ছিলেন। তাদের বেশিরভাগই নাটোরের জজ আদালতে মামলার হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।

আহত যাত্রী জাহাঙ্গীর বলেন, “আমাদের অথৈ পরিবহনের বাসের অধিকাংশ যাত্রী নাটোর কোর্ট থেকে উঠেছিলাম। বাকি কয়েকজন নাটোর বাসস্ট্যান্ড থেকে ওঠে।”

দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাজারও মানুষ ঘটনাস্থল ঘিরে রয়েছেন। স্বজনদের খোঁজে অনেককে ছুটোছুটি করতেও দেখা যায়। মহাসড়কের ওপর অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশও পড়ে ছিল। বনপাড়া হাইওয়ে থানায় সারি করে রাখা লাশের ওপর আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ছিল।

দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে যাদের অবস্থা গুরুতর, বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হতে থাকে।

রাত ৯টা পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেলে ১৭ জনকে নেওয়া হয় বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

তিনি বলেন, এদের চিকিৎসার জন্য ১০ জন অতিরিক্ত চিকিৎসককে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সেখানে গুরুদাসপুরের সীমা খাতুন ও তার বাবা জহুরুল ইসলামও রয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সীমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তার বাবা জহুরুল।

এই দুর্ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও আহতদের সুচিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। 

দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, দুই ঘণ্টা পর বিকাল পৌনে ৬টার দিকে যান চলাচল পুনরায় শুরু হয়। রাজশাহী বিভাগের পাশাপাশি কুষ্টিয়া যেতেও এই মহাসড়ক ব্যবহার করা হয়।

দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে নাটোর জেলা প্রশাসন। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) এবং বিআরটিএ-র সহকারী পরিচালক।