মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ডুবে যাওয়ার তিন দিনে লঞ্চের অবস্থান সনাক্ত না হলেও পদ্মা নদীর ভাটিতে ও বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি মেঘনার বিভিন্ন স্থানে ভেসে উঠছে লাশ।
Published : 06 Aug 2014, 10:58 AM
মাওয়ায় দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ভোলা সদর ও চাঁদপুরের হাইমচরের মেঘনা, শরীয়তপুরে পদ্মা এবং বরিশালের ছোট কালাবদর ও মেঘনা নদী থেকে মঙ্গল ও বুধবার ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ নিয়ে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২১ জনের লাশ পাওয়া গেছে। স্বজনদের অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি করা নিখোঁজদের তালিকা অনুযায়ী এখনো ১২৩ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে কাওড়াকান্দি থেকে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়া ঘাটে যাওয়ার পথে লৌহজং ক্রসিংয়ে লঞ্চ এমএল পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ১১০ জনকে উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার পর থেকে কয়েকটি নৌযান নিয়ে ‘ল্যাডার স্ক্যানার সার্চ’ চালিয়ে লঞ্চটির অবস্থান বের করার চেষ্টা চালানো হলেও তাতে সফল হননি উদ্ধারকর্মীরা।
উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও নির্ভীক এবং বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ, টাগ বোট, স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ১৫টি নৌযান মাওয়ায় থাকলেও লঞ্চের অবস্থান জানতে না পারায় উদ্ধার অভিযান কার্যত শুরুর জায়গাতেই আটকে থাকে।
তবে বুধবার রাত ১২টার দিকে শক্তিশালী যন্ত্রপাতি নিয়ে টাগবোট ‘কাণ্ডারি-২’ মাওয়ায় পৌঁছে তল্লাশি শুরু করে, লঞ্চের অবস্থান খুঁজে পেতে যেটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে উদ্ধারকর্মীরা আশা করছেন।
উদ্ধার অভিযানে থাকা নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম জানান, যে সাইড স্ক্যান সোনার দিয়ে কাজ চলছিল, তা নদীর গভীরে ৭৫ ফুট পর্যন্ত এলাকা স্ক্যান করতে পারে। কিন্তু কাণ্ডারি-২ যেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে তা দিয়ে আড়াইশ’ ফুট পর্যন্ত স্ক্যান করা যায়।
এদিকে তিন দিনেও লঞ্চের অবস্থান সনাক্ত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন মাওয়ায় অবস্থানরত নিখোঁজদের স্বজনরা। লাশের অপেক্ষায় দিন-রাত মাওয়ায় কাটাচ্ছেন তারা।
গত তিন দিনে যাদের লাশ উদ্ধার হয়েছে তাদের মধ্যে আট জনের লাশ সনাক্ত হওয়ার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানান।
এই আটজন হলেন- শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে উদ্ধার হওয়া মাদারীপুরের শিবচরের নুরুল ইসলাম হাওলাদারের ছেলে মিজানুর রহমান (৩৫), মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের খালাশিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা ইমা আক্তার (২২), শরীয়তপুরের জাজিরা গ্রামের আবদুল জব্বার খানের মেয়ে লাকী (২০), ভোলা থেকে উদ্ধার হওয়া ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার লুৎফর রহমান আকনের ছেলে ফাহাদ হোসেন আকন (২৪), চাঁদপুরের রাজরাজেশ্বর এলাকা থেকে উদ্ধার করা ফরিদপুর জেলার মানিকনগর সালমা নগরকান্দা গ্রামের মনির উদ্দিন ফকিরের ছেলে জামাল হোসেন (২৫), মঙ্গলবার চাঁদপুরে উদ্ধার হওয়া ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার আব্দুল হাইয়ের মেয়ে রিতা আক্তার (২৫)।
এছাড়া দুর্ঘটনার পরপরই মাওয়ার পদ্মা নদী থেকে মাদারীপুরের শিবচর থানার গোয়াখোলা গ্রামের নুরুল হকের মেয়ে হীরা (২২) ও একই এলাকার উত্তারাইল গ্রামের আলম শেখের স্ত্রী হাসি বেগমের (৫৫) লাশ উদ্ধার করা হয়।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে নদীপথে শরীয়তপুরের নড়িয়ার দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। আর মাওয়া থেকে চাঁদপুর সদরের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার, হাইমচরের দূরত্ব ৬৬ কিলোমিটার এবং ভোলা সদরের দূরত্ব ৯৯ কিলোমিটার।
এরপরই সাগর শুরু হওয়ায় নদীতে ভেসে লাশ সমুদ্রে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
চাঁদপুরে তিন জনের মৃতদেহ
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নে দুটি এবং সদর উপজেলার রাজ রাজেশ্বর এলাকায় মেঘনায় একটি লাশ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে একজনের পরিচয় জানা গেছে। সনাক্ত করা হয়েছে মঙ্গলবার চাঁদপুরে পাওয়া আরেক নারীর লাশ।
চাঁদপুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. জাহিদ হোসেন জানান, সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর এলাকা থেকে উদ্ধার করা যুবকের নাম জামাল হোসেন (২৫)। তিনি ফরিদপুর জেলার মানিকনগর সালমা নগরকান্দা গ্রামের মনির উদ্দিন ফকিরের ছেলে।
“তার পরনে জিন্স প্যান্ট ও শার্ট ছিল। পকেটে থাকা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মাধ্যমে পুলিশ তার পরিচয় জানতে পারে।”
এছাড়া নীলকমল ইউনিয়নের মাঝিরবাজারে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারী এবং মিয়ার বাজারে আনুমানিক ৩৩ বছর বয়সী এক যুবকের লাশ পাওয়া যায়।
নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াসিন রতন জানান, সকালে মেঘনা নদীতে লাশ ভাসতে দেখে এলাকাবাসী খবর দেয়। পরে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবারও নীলকমল ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকার মেঘনা নদী থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ, যার মধ্যে একজন মুন্সীগঞ্জের ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রী ছিলেন।
লঞ্চডুবির ঘটনায় মাদারীপুরের শিবচরে বসানো কন্ট্রোল রুমে পাঠানোর পর স্বজনরা তার লাশ সনাক্ত করেন।
নিহত রীতা (২৫) বেগম ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তিনি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার আব্দুল হাইয়ের মেয়ে।
মুন্সীগঞ্জে দুই লাশ
মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় যে স্থানে পিনাক-৬ ডুবে যায়, সেখান থেকে আড়াই কিলোমিটার পূর্ব দিকে বুধবার বিকালে ভেসে ওঠে এক নারীর লাশ।
উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর ফয়সালুর রহমান জানান, তারা পদ্মা থেকে লাশটি উদ্ধার করে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছেন।
“বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা বোট নিয়ে মাওয়া ঘাট থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে ওই এলাকায় যাই। নিহত মহিলার বয়স আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ বছর।”
এছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকে আরো একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে মাওয়ার তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়।
ভোলায় ছয় লাশ
বুধবার সকাল থেকে ভোলা সদরের রাজাপুর, কাঠিরমাথা, ভাংতির খাল, ইলিশা ঘাট ও মেদুয়া এলাকায় মেঘনা নদী থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের পরিচয় জানা গেছে।
জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর এলাকার নদীতে এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়।
লাশ উদ্ধারের পর তার পকেটে পাওয়া মোবাইল ফোনের সিম থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ওই যুবকের নাম ফাহাদ হোসেন আকন (২৫)। তিনি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার লুৎফর রহমান আকনের ছেলে।
“সে তেজগাঁও কলেজে বিবিএতে পড়তো। ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরছিল বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে।”
লৌহজংয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. খালেকুজ্জামান জানান, ফাহাদের নাম নিখোঁজের তালিকার ৯৭ নম্বরে ছিল।
ভোলা থানার ওসি মোবাশ্বির আলী জানান, ভোলা সদরের কাঠির মাথা এলাকা থেকে আনুমানিক ৪৫ বছর বয়সী দাড়িওয়ালা একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর ভাংতির খাল এলাকায় নদীতে পাওয়া যায় আনুমানিক ১০ বছরের একটি মেয়ে এবং ১২ বছর বয়সী এক কিশোরের লাশ।
এছাড়া কালীগঞ্জ এলাকায় এক কিশোরের লাশ ভাসার খবর পেয়ে কোস্ট গার্ড সেটি উদ্ধার করে।
কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের কমান্ডার নজরুল ইসলাম জানান, ছেলেটির বয়স আনুমনিক ১৪ বছর।
এদিকে রাত ১১টার দিকে দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া এলাকায় মেঘনা নদী থেকে পুলিশ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে বলে ভোলার জেলা প্রশাসক মো, সেলিম রেজা জানান।
নিহতের পরিচয় জানা যায়নি। তবে তার বয়স আনুমানিক ৪০ বছর।
পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামন জানান, উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত পরিচয় লাশগুলো মাদারীপুরের শিবচরে বসানো কন্ট্রোল রুমে পাঠানো হচ্ছে।
বরিশালে দুই লাশ
বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট ফেরিঘাট সংলগ্ন ছোট কালাবদর নদী থেকে বুধবার দুপুরে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর থানার ওসি রেজাউল করিম জানান, লাশটি পদ্মায় ডুবে যাওয়া এমএল পিনাক-৬ এর যাত্রীর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আনুমানিক ৪০ বছর বয়সী ওই নারীর পরনে ‘খয়েরি’ রংয়ের কামিজ ও বোরখা ছিল।
এ বিষয়ে মাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান ওসি।
সন্ধ্যায় মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি উজ্জ্বল কুমার দে জানান, শিশুটির বয়স আনুমানিক ৮-৯ বছর হবে। পরনে জিন্স প্যান্ট, সবুজ রংয়ের গোলগলার টি-শার্ট এবং পায়ে কালো জুতা।
শরীয়তপুরে চার লাশ
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা ও কাঁচিকাটা, গোসাইর হাট উপজেলার কোদালপুর এবং জাজিরা থেকে এক শিশুসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় জানা গেছে।
নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরা বেগম জানান, বুধবার দুপুরে চরআত্রা ইউনিয়নের চরশ্রীপুর এলাকায় পদ্মা নদীতে আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী এক তরুণীর লাশ পাওয়া যায়। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।
তাকে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশ পাড়া গ্রামের আবদুল জব্বারের মেয়ে জান্নাতুল নাইম লাকী মনে করে ওই স্বজনরা লাশ নিয়ে যায়। সেখানে তার দাফনেরও ব্যবস্থা হয়।
কিন্তু দাফনের আগে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা লাশ দেখে জানান, সে লাকী নয়।
পরে ওই মৃতদেহ মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাঁচচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠের অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হলে সেখানে তার লাশ সনাক্ত করা হয়।
তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, ওই তরুণীর নাম ইমা আক্তার (২২)। তার বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের খালাশিকান্দি গ্রামে।
ইমা ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন বলে তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়।
এদিকে বেলা ১২টার দিকে কাঁচিকাটা ইউনিয়নে পদ্মা থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধর করে মাদারীপুরে পাঠানো হয়।
মুন্সীগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার জানান, নিহত ওই যুবক মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার নুরুল ইসলাম হাওলাদারের ছেলে মিজানুর রহমান (৩৫)। তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গোসাইর হাট উপজেলার কোদালপুরে পাওয়া যায় আনুমানিক দেড়বছর বয়সী এক শিশুর লাশ।
এছাড়া জাজিরা উপজেলা থেকেও আরেকটি লাশ উদ্ধার করা হয় বলে মাওয়ার অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্র থেকে জানানো হয়।