ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে বাংলাদেশই লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষক অধ্যাপক কাওসার আহমেদ।
Published : 10 Jul 2014, 08:42 PM
তার মতে, অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমার পরিসর বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের খনিজ অনুসন্ধানের ক্ষেত্র যেমন বেড়েছে, তেমনি মৎস্য সম্পদ আহরণ বাড়ানোর সুযোগও তৈরি হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালত বা পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশনের (পিসিএ) রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি মত প্রকাশের মধ্যে এই মত দিলেন এই বিশেষজ্ঞ।
এই রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে।
রায়ে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে বলে সরকার বললেও বিএনপির দাবি, আদালতে তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনে সরকারের ব্যর্থতায় বঙ্গোপসাগরে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ন্যায়সঙ্গত রায় হয়েছে- মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কাওসার বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“যে যাই বলুক না কেন, এই রায়ে বাংলাদেশই লাভবান হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল না।”
তার মতে, মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধে মামলায় বিজয়ের পর ভারতের সঙ্গে এই রায়ে অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা বেড়ে যাওয়ায় প্রাণিজ বা মৎস্য সম্পদ ও খনিজ সম্পদ আহরণ দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে।
খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে লাভের দিকটি তুলে ধরে অধ্যাপক কাওসার বলেন, “বিরোধ থাকায় এতদিন আমাদের ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো টেন্ডার জমা দিতে চাইত না। এখন দশটি ব্লকের সবগুলোই আমরা পাওয়ায় এক্ষেত্রে আর কোনো সমস্যা হবে না।
“বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সাগ্রহে টেন্ডার জমা দেবে। অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তেল-গ্যাসে সৃমদ্ধশালী একটি দেশ হবে।”
সমুদ্র বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
সমুদ্রসীমা বিরোধের ক্ষেত্রে ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে রেখা টানার পক্ষে মত দিলেও বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে রেখা টানার দাবি জানায়।
বাংলাদেশের দাবি ছিল, বঙ্গোপসাগর ও ভূমির মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রির সোজা রেখা যাবে। তবে ভারত বলেছিল- সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি থেকে।
রায়ে বলা হয়েছে, ১৭৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট দ্রাঘিমাংশে (ওই বিন্দু থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রমিত কোণ) এই রেখা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমার সঙ্গে মিলবে।
“এতেই প্রমাণিত হয়, রায়ে বাংলাদেশের লাভবান হয়েছে,” বলেন অধ্যাপক কাওসার।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত বিরোধের সমাপ্তি ঘটল বলে মনে করেন তিনি।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের এলাকা হারানো নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে যে বিতর্ক তোলা হয়েছে, তা অহেতুক বলে মন্তব্য করেন সমুদ্র বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।
“তালপট্টির কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় এই নতুন দ্বীপের উৎপত্তি হয়েছিল।”
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সীমানায় এই দ্বীপের মালিকানা দাবি করে এর নাম দেয়া হয় দক্ষিণ তালপট্টি। অন্যদিকে ভারতও নিজেদের মানচিত্রে এর অধিকার দাবি করে, নাম দেয় পূর্বাশা বা নিউ মুর।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন বলেছেন, “এই দ্বীপটি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জিয়াউর রহমান আমলে এই দ্বীপটির মালিকানা দাবি তোলা হয়। তিনি (জিয়া) এই দ্বীপের মালিকানার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
“ওই সময়ে ভারতও এই দ্বীপের দাবি জানিয়েছিল। এই নিয়ে দুই দেশের যুদ্ধ জাহাজও সেখানে গিয়েছিল। এই দ্বীপটির অধিকার ছেড়ে দেয়া উচিৎ হয়নি।”
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, “তালপট্টি এখন নেই। তালপট্টি যে জায়গায় ছিল এ সীমানাটি ভারতের দিকে পড়লেও এর নিচের (দক্ষিণে) বিশাল জায়গায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
আশির দশকের শুরুতে এই দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত টানাপড়েন নতুন মাত্রা পায়। বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দিলেও ১৯৮১ সালে ভারত সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে নিজেদের পতাকা ওড়ায়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাজনীতিতেই তালপট্টি ঘুরে ফিরে আসে।
অধ্যাপক কাওসার বলেন, “১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত তালপট্টি ছিল। এরপর আর এই দ্বীপের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। ৪/৫ বছর আগে দু-একটি গাছের মাথা দেখা যেত। তাও এখন আর দেখা যায় না।”