বাংলাদেশ সফররত বিদেশি অতিথিদের কাছে `অভিযোগ' করা থেকে বিরত থাকার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 27 Jun 2014, 09:29 PM
শুক্রবার সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকে `দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই' বলে খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পর এ আহ্বান জানালেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা বলেন, “দেশের মানুষের সমর্থন না পেয়ে বিদেশি প্রভুদের পা ধরে কান্নাকাটি। আওয়ামী লীগ বিদেশি প্রভুদের পা ধরে কাঁদে না। আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
“যারা আবোল- তাবোল বকে যাচ্ছে-আমরা তাদের মনের ব্যথা বুঝি। রাজনীতিতে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচনে আসেন নাই। এখন এই নির্বাচন হয়ে গেছে। ঠেকাতে পারেন নাই। এখন নানা ধরনের ষড়যন্ত্র।”
খালেদা জিয়ার প্রতি বিদেশিদের কাছে ‘অভিযোগ’ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মানুষ খুন করা, আর অন্যের কাছে গিয়ে কাঁদাকাটি করে দেশের বদনাম করা- এটা একটু বন্ধ করেন।”
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রা ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করতেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঘোষণা দিয়েছিলাম, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করবো। কারো কাছে মাথা নত করবো না। ইনশাল্লাহ, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেছি।”
সম্প্রতি জয়পুরহাটে এক সমাবেশে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ‘গচ্ছিত’ অর্থের তদন্তের দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, “এই সরকারের আমলে যারা দেশে দুর্নীতি করেছে তারা পদ্মা সেতু, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট, পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ চুরি করে সুইস ব্যাংকে পাচার করেছে।”
তার ওই বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তদন্তে দেখা যাবে যে, সুইস ব্যাংকে খালেদা জিয়ারও গুচ্ছিত অর্থ আছে।
“আজকে সুইস ব্যাংকের টাকার হিসাব এসেছে। ইতিমধ্যেই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। কার কার টাকা আছে- সেই তালিকাও যেমন আনবো, টাকা কিভাবে ফেরত আনতে হয়- ইনশাল্লাহ সে ব্যবস্থাও আমরা নেব।”
জয়পুরহাটের ওই জনসভায় খালেদা জিয়া তার স্বামী জিয়াউর রহমান হত্যার সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিভিন্ন তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তার স্ত্রী এতোকাল পরে অভিযোগ করতে এসেছেন, জিয়াকে নাকি আমরা হত্যা করেছি। আমরা কেন হত্যা করতে যাবো? আমি যদি বেগম জিয়াকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি কি করেছিলেন?
“জিয়া যখন নিহত হলো, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় চলে আসলো। একখানা বাক্স নিয়ে আসলো। আপনি তো জিয়ার স্ত্রী, আপনি তো স্বামীর লাশ ওখানে আছে কি নাই- জানতে চান নাই। আপনার ছেলে তো বাবার মরা মুখটা দেখতে চায় নাই।”
স্বামীর হত্যাকারী হিসাবে এরশাদকে দায়ী করতে খালেদা জিয়া কেন ১০ বছর সময় নিলেন- সে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৮১ সালে জিয়া মারা গেছে। ’৯০ সালে গিয়ে খালেদা জিয়া গুলিস্তান চত্বরে প্রকাশ্য জনসভায় দাবি করলেন, এরশাদ জিয়ার হত্যাকারী। এতোকাল পরে মনে পড়লো? ৮১ থেকে ৯০? এতোদিন কেন মনে পড়ে নাই?
“খুনীর কাছ থেকে বাড়ি-গাড়ি নিলেন। ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তে একখানা বাড়ি। খুনীর কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টে নয় বিঘা, সাড়ে নয় বিঘার বাড়ি নিয়ে আরাম আয়েশে বসে থাকলেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি খালেদা জিয়াকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। জিয়া যখন নিহত হয় আমরা তখন সিলেটে ছিলাম। আমরা সিলেটে গিয়েছিলাম মাজার জিয়ারত করতে। আমি যখন ফিরে আসি.. বন্যায় শায়েস্তাগঞ্জের রেল সেতু উড়ে গেছে। আমাদের সেখানেই থাকতে হয়। এরপর আখাউড়া পর্যন্ত আমরা যখন আসি, তখনই আমরা শুনলাম জিয়া নিহত হয়েছে। ক্যু হয়েছে। ট্রেন আর ঢাকায় যাবে না। আমরা সকল নেতৃবৃন্দ একসাথে। আমরা বললাম, আমরা ভাগে ভাগে ঢাকায় চলে যাবো। একসাথে এতজন কোথায় যাবে?
“আমরা ভৈরব থেকে চলে আসি ঢাকায়। আমি আমার মেঝো ফুপুর বাড়িতে উঠি। তখন আমার কোনো থাকার বাড়ি ছিলো না। এরপর, আমরা ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করি। আমাদের সব সময় প্রচেষ্ঠা ছিলো যেন, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা থাকে।”
জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আওয়ামী লীগের প্রথম বিবৃতি দেয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি একটা বিবৃতি লিখলাম। আমরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা চাই। আমাদের ভয় ছিল- এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে না মার্শাল ল জারি হয়। প্রথম বিবৃতি আমারই দেওয়া।”
জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর এরশাদের ক্ষমতা দখলের পিছনে খালেদা জিয়া মদদ ছিল বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
“আমি যদি বেগম জিয়াকে জিজ্ঞাস করি, এরশাদ ক্ষমতা নেয়ার সাহস পেলো কোথ থেকে যদি আপনি তাকে মদদ না দিয়ে থাকেন,” বলেন তিনি।
পুরো পরিবার খুনী:
জিয়াউর রহমানের পুরো পরিবারকে ‘খুনী’ বলে মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমাকে বারবার হত্যার চেষ্টা করেছেন। চট্টগ্রামে আমার মিছিলে যার নির্দেশে গুলি চালানো হয়, সেই রবিবুল হুদাকে আপনি প্রমোশন দিয়েছিলেন।
“খুন করা তারই (খালেদা জিয়া) অভ্যাস। খুন করতে তারাই পরদর্শী। যেমন- তার স্বামী খুনী, নিজে খুনী, তার ছেলে খুনী, তার পুরো পরিবারই খুনী।”
স্বাধীনতার অর্জনকে নস্যাৎ করতে বঙ্গবন্ধুসহ কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল আওয়ামী লীগের কুলাঙ্গার খন্দকার মোশতাক। খন্দকার মোশতাক এই সাহস পেল কোথা থেকে? কারা এর পেছনে ছিল? এটা তো স্পষ্ট। খন্দকার মোশতাক সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে কাকে পছন্দ করে নিয়েছিল? পছন্দ করে নিয়েছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।”
আওয়ামী লীগের সাংসদদের হত্যাসহ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি (খালেদা) তো চান নাই- বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। ওনার যে পেয়ারে পাকিস্তান এটা ভুলতে পারেন নাই। ওই পেয়ারে পাকিস্তান ভুলতে পারেন নাই বলেই, পাকিস্তানিদের পরাজয় মেনে নিতে পারেন নাই বলেই, বারবার চেষ্টা করেছেন যেন বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।”
আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তার দলের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, “এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাঙালি জাতির সকল অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।
“আমাদের জাতির পিতা কখনো আপোষ করেন নাই। আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগের অনেক শত্রু ছিল। কোনো ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারে নাই।”
বিকাল ৪টা ২২ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভা মঞ্চে এসে উপস্থিত হন শেখ হাসিনা।
আলোচনা সভা মঞ্চের পেছনে বিশাল ব্যানারের ডান দিকে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাঁ দিকে শেখ হাসিনার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। আর মাঝে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের ছবি।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও সাহারা খাতুন, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মণি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।