মিরপুরের কালশীতে বিহারি ক্যাম্পে ১০জন নিহতের ঘটনাকে সরকারি বিদ্যুতের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসীদের অনেকে।
Published : 15 Jun 2014, 01:09 AM
শনিবার ভোরের দিকে এক সংঘর্ষের ঘটনার সময় ক্যাম্পের কয়েকটি ঘরে আগুন দেয়া হলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় নয়জন। পরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় আরেকজন।
দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পের প্রবেশ মুখে একটি স্টেশনারি দোকান ভাঙা, দোকানের শাটারে দায়ের কোপের চিহ্ন। পাশের অন্তত দশটি বাড়ি থেকে তখনো ধোঁয়া উঠছিল। ক্যাম্পের শতাধিক বাড়ির দরজায় ঝুলছিল বড় বড় তালা।
বাসিন্দা মো. পাপ্পু বলেন, “জীবন বাঁচাতে বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে আসবেন তারা।”
এলাকাবাসী জানায়, বিহারি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী একটি বস্তিতে (রাজুর বস্তি) অবৈধ বিদুৎ সংযোগ দেয়াকে কেন্দ্র করে বিহারীদেরই দুটি পক্ষ ও স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল।
কালশী বিহারি ক্যাম্পে ১১০০ পরিবার বাস করে জানিয়ে ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মো. মুন্না হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও পানি পেয়ে আসছি। শরণার্থী হিসেবে এটা আমাদের প্রাপ্য।”
দশ বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলে পরে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে আবার তারা বিদ্যুৎ পান বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, প্রায় ছয় মাস আগে ক্যাম্প সংলগ্ন রাজুর বস্তির বাসিন্দারা তাদের না জানিয়ে ক্যাম্পের ট্রান্সফরমার ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া শুরু করলে তারা প্রথমে এর প্রতিবাদ করেন। তাতে কাজ না হওয়ায় তিন মাস আগে বিদুৎ অফিসে অভিযোগ করেন তারা।
বিদুৎ অফিসের কর্মীরা ক্যাম্পে এসে ১২ দিন আগে ওই সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন বলে জানান তিনি।
ক্যাম্প পরিচালনা কমিটির সভাপতি জব্বার খান বলেন, “গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা আমাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আমাদের অনুরোধ করেন, আমাদের ট্রান্সফরমার থেকে বস্তির বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে আমরা যেন আপত্তি না করি।
“তিনি বলেছিলেন, আপাতত কয়েক মাস যেন আমরা তাদের সহযোগিতা করি। এরপর তিনি বস্তির বাসিন্দাদের জন্য পৃথক বিদ্যুতের ব্যবস্থা করবেন।
“কিন্তু আমরা তার কথায় আপত্তি জানিয়ে বলেছিলাম, আমাদের লাইন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা হবে। আর আমরা আমাদের বিদ্যুৎ কেন দেব? তিনি সরকারের প্রতিনিধি, তিনি যেন বস্তির বাসিন্দাদের জন্য পৃথক বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন।”
এই ঘটনার জের ধরেই ভোরে ক্যাম্পে হামলা হয়েছে বলে মনে করছেন জব্বার ও মুন্না।
একই অভিযোগ করেন মো. মিন্টু, মো. পাপ্পুসহ ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা।
এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিন আতাউর রহমানও মনে করেন বিদ্যুৎ নিয়ে বিরোধের বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।
তিনি জানান, কয়েক বছর আগে গড়ে ওঠা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী রাজুর বস্তিতেও বিহারীরা বসবাস করেন। কিছু বাঙালিও বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকছেন।
তিন দিন আগে এলাকায় সাংসদ আসলে ক্যাম্পবাসী রাজুর বস্তিতে বিদ্যুত সংযোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তখন সাংসদ ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্যাম্প ছেড়ে যান বলেও জানান তিনি।
“ক্যাম্পবাসী সেদিনই অনেকটা ক্ষুব্ধ হতে শুরু করেছিল। এলাকায় থমথমে পরিবেশ ছিল,” বলেন মুয়াজ্জিন।
মুয়াজ্জিন আতাউর বলেন, তিন দিন আগে কালাপানি এলাকার দারুল আমান জামে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়-ক্যাম্পের পাশের রাজুর বস্তিতে ক্যাম্পবাসী কোনভাবেই বিদ্যুত সংযোগ নিতে দেবে না। এজন্য কালশী ক্যাম্পের সবাইকে এক থাকতেও নির্দেশ দেয়া হয় মসজিদের মাইক থেকে।
পল্লবী থানার ওসি জিয়াউজ্জামান বলেন, “এই বিহারী ক্যাম্পে সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ নিয়ে ব্যবসা চলে। অনেক বিহারি চোরাপথে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুতের লাইন দিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে।”
“এ সময় বিহারীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে আতশবাজি ফোটায় এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে মারধর করে। তখন পুলিশকে সাহায্য করতে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা এগিয়ে আসলে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।”
ওসি বলেন, বিহারীরা এক যুবককে কুপিয়ে আহত করার পর কারা যেন সেখানে ঢুকে আগুন দেয়। মালামাল লুটপাট করে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পানদোকানি বাদশা মিয়া (৬০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিহারীরা পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে আতশবাজি ফোটালে পুলিশ স্থানীয় কয়েকজনের সহযোগিতা চায়। এরপর পুলিশ-জনতা মিলে বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের উপর হামলা চালানো হয়।”
“সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশের গাড়িতে চড়ে সংসদ ইলিয়াস মোল্লার লোক বলে পরিচিত এক যুবলীগ নেতার পোলাপান বিহারী ক্যাম্পে হামলা করে, আগুন দেয় ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়,” বলেন ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. মুরাদ।
অভিযোগ নাকচ করে সাংসদ ইলিয়াসউদ্দীন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ইলিয়াস মোল্লা খুনের রাজনীতি করি না। এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করি।”
তিনি বলেন, তিন দিন আগে বিদ্যুৎ নিয়ে বিহারীরা নিজেরা ঝগড়া করেছিল। এজন্য তারা সড়ক অবরোধ করেছিল।
হামলার পর বিহারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সাংসদ সাহিদা তারেখ দীপ্তি।
তার বিষয়ে ইলিয়াস বলেন, “দলের মনোনয়ন না পেয়ে শুনেছি ও আমার বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থলে এসে এক টিভিতে বলেছে, আমি এ ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
“দলকে ভালবাসলে দলীয় নেতার বিরুদ্ধে এমন ডাহা মিথ্যা কথা কেউ বলতে পারে না।”