‘বিহারি ক্যাম্পে’ সংঘর্ষ-আগুন, নিহত ১০

রাজধানীর মিরপুরের কালশীতে আতশবাজি পোড়ানোকে কেন্দ্র করে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে সংঘর্ষে ১০ জন নিহত হয়েছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2014, 04:53 AM
Updated : 14 June 2014, 06:25 PM

বিহারি ক্যাম্প নামে পরিচিত ওই এলাকায় শনিবার ভোরের দিকের এই সংঘর্ষের সময় কয়েকটি ঘরে আগুন দেয়া হলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান নয়জন। এছাড়া দুপুর পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন একজন।

ভোরে সংঘর্ষের পর পুলিশ সেখানে গেলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পের বাসিন্দারা। দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে।

ক্যাম্পের ভেতরে পুলিশকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। ফলে লাশের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারছিল না পুলিশ।  দুপুরের পর ঢাকার জেলা প্রশাসক শেখ ইউসুফ হারুন যাওয়ার পর লাশ দিতে সম্মত হয় ক্যাম্পবাসীরা।

ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে ইউসুফ হারুন সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনা সফল হয়েছে।  লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে এলাকাবাসী।”

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অগ্নিদগ্ধ মোট নয়টি লাশ পুলিশ উদ্ধার করেছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। এরপর লাশগুলো নিয়ে একটি পুলিশের একটি পিকআপ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

এছাড়া সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত একজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। তার নাম আজাদ বলে স্থানীয়রা জানায়।

সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্র সাংবাদিক আসিফ মাহমুদ অভি ক্যাম্পে নয়জনের লাশ দেখতে পান। এদের দেহ পুড়ে গিয়েছিল। নিহতদের মধ্যে চারজন নারী ও দুটি শিশু রয়েছে।

ক্যাম্পের বাসিন্দা মুন্না নামে এক যুবক আগুনে পুড়ে নিহত নয়জনের মধ্যে সাতজনের পরিচয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। নিহতরা হলেন- বেবি, ফারজানা, লালু, ভুলু, সাহানি, সুলতানা ও মারুফ।

আব্দুল শাহজাহান নামে একজন জানান, নিহতরা সবাই এক পরিবারের সদস্য।

ঢাকা মেডিকেলে থাকা আজাদের মৃতদেহে ছররা গুলির চিহ্ন রয়েছে।

তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন কি না-জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার কামাল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “সংঘর্ষের সময় এলাকাবাসীও পুলিশকে লক্ষ্য করে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল।

“তারাও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তাই কাদের গুলিতে তার মৃত্যু হয়েছে, তা এখনি বলা যাচ্ছে না।”

সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্যও আহত হন বলে সহকারী কমিশনার কামাল জানান। 

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন বদর উদ্দীন (৫৬), আরজু (১৮), আসলাম (৪৫) এবং মো. সরদারের (৬০) শরীরের বিভিন্ন অংশে ছররা গুলির চিহ্ন রয়েছে। আহত মো. নাদিমের মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

একই ঘটনায় দেহের ১৭ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে ফারজানা (১৬) নামে এক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

জেলা প্রশাসকের আগে বেলা পৌনে ২টার দিকে ঘটনাস্থলে যান ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাহিদা তারেখ দিপ্তী।

তিনি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে লাশ হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তবে তখনো লাশ দিতে চাচ্ছিল না ক্যাম্পবাসী।

সকালে পুলিশ উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লাশ হস্তান্তরও করতে বললেও স্থানীয়রা তাদের কোনো সহায়তা করছে না।

শবে বরাতের রাত শুক্রবার আতশবাজি পোড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল পুলিশের। এর মধ্যেই এই সংঘর্ষ বাঁধে।

সহকারী কমিশনার কামাল জানান, আতশবাজি পোড়ানোসহ সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে তারা ৬৬ জনকে আটক করেছেন।

জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন লাশ হস্তান্তরের সময় ক্যাম্পবাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন, আটক ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হবে। ঘটনার সামগ্রিক প্রতিবেদন তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হবে।

সাবেক সংসদ সদস্য সাহিদা তারেখ সাংবাদিকদের জানান, সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। যাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।

এই সংঘর্ষের শুরু ভোর ৬টায় হয় বলে ক্যাম্পের বাসিন্দা শাহজাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

তিনি বলেন, সকালে হঠাৎ করে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে অন্তত ১০টি ঘর পুড়ে যায়। আরো বেশ কয়েকটি ঘরে ভাংচুর হয়েছে।

উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “ভোররাতে বিহারিদের পটকা ফাটানো নিয়ে কয়েকটি দল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এর জেরে ঘরে আগুন দিলে কয়েকজন মারা যায়।”

আটকে পড়া পাকিস্তানিরা হামলার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার দিকে অভিযোগ তুলেছেন।

নির্বাচনী এলাকায় এই ঘটনার পর সেখানে দেখা যায়নি সাংসদ ইলিয়াসকে। তিনি আসেননি কেন- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেত্রী সাহিদা বলেন, “ইলিয়াস কেন আসেননি তা লোকজন জানে, তারাই বলতে পারবে।”

এ বিষয়ে সাংসদ ইলিয়াসউদ্দীন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ইলিয়াস মোল্লা খুনের রাজনীতি করি না। এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে সবার সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করি।”

তিনি বলেন, তিন দিন আগে বিদ্যুৎ নিয়ে বিহারীরা নিজেরা ঝগড়া করেছিল। এজন্য তারা সড়ক অবরোধ করেছিল।

“আমি সেখানে রাত ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলাম, ওদের বলেছি আপাতত এক ট্রান্সফরমার ভাগ করে সবাই বিদ্যুত ব্যবহার করো। পরে আমি সমস্যা সমাধান করে দেব। কিন্তু ওরা (বিহারীরা) কিছুতেই একমত হতে না পারায় আমি কোন সমাধান ছাড়াই এলাকা থেকে চলে আসি।”

সাবেক সংসদ সাহিদার বিষয়ে তিনি বলেন, “দলের মনোনয়ন না পেয়ে শুনেছি ও আমার বিরুদ্ধে। ঘটনাস্থলে এসে এক টিভিতে বলেছে, আমি এ ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।

“দলকে ভালবাসলে দলীয় নেতার বিরুদ্ধে এমন ডাহা মিথ্যা কথা কেউ বলতে পারে না।”

মিরপুরের এই ঘটনার পর মোহাম্মদপুরসহ অন্যান্য স্থানে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।