যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেটের পুনর্নির্বাচিত মেয়র লুৎফুর রহমানের গোপন কিছু বিতর্কিত যোগাযোগ ও কর্মকাণ্ড প্রকাশ করে দিয়েছেন পুরস্কারজয়ী এক ব্রিটিশ সাংবাদিক।
Published : 25 May 2014, 09:25 PM
দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফে নিজের ব্লগে বিতর্কিত সেবিষয়গুলো তুলে ধরেছেন সাংবাদিক এন্ড্রু গিলিগান।
সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের বিরুদ্ধে আক্রমণে যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণকে বৈধতা দিতে টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে লেবার পার্টির সরকার যেসব গোয়েন্দা তথ্যাদি ‘রঙ চড়িয়ে উপস্থাপন করেছিলেন’ তা নজরে এনে আলোচিত হন তৎকালীন বিবিসি সাংবাদিক গিলিগান।
বিবিসির পানোরামা প্রোগামসহ গণমাধ্যমে নিজের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারের মুখোমুখি হলেও লুৎফুর দাবি করেছেন, পুলিশের তদন্তে এবং ক্যাবিনেটের মন্ত্রী এরিক পিকলসের নির্দেশিত তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোনো ‘কুকর্মের’ অভিযোগের ‘নির্ভরযোগ্য প্রমাণ’ পাওয়া যায়নি।
উল্টো, প্যানোরামায় নিজেকে নিয়ে প্রকাশিত খবরের জন্য বিবিসির বিরুদ্ধে ‘বর্ণবাদের‘ অভিযোগ আনেন লুৎফুর।
লুৎফুর রহমানের সঙ্গে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কথিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাকে সমালোচনা করছেন টাওয়ার হ্যামলেটের অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। এতে তাদের কম্যুনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
তারা বলছেন, লুৎফুরের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে লন্ডনভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের, যারা চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের মতো দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক এই আল-বদর কমান্ডার তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে পাত্তা দেননি।
পূর্ব লন্ডনের এক প্রবাসী বাংলাদেশি পেশাজীবী বলেন, “লুৎফুর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদী ও স্থানীয় পাকিস্তানিদের সম্পর্ক আছে, যা যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপর বদনাম ছড়াচ্ছে। ১৯৭১ সালের আগে-পরে অনেক ভোগান্তির শিকার, আমরা বাঙালিরা এইসব পাকিস্তানিদের সাথে থাকাকে ঘৃণা করি।”
সম্ভাব্য প্রতিশোধের আশঙ্কায় তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তিনি বলেন, লুৎফুর মোল্লাদের সমর্থনপুষ্ট, যার হোয়াইট চ্যাপেল রোডে পূর্ব লন্ডন মসজিদে চরমপন্থীদের জন্য আস্তানা তৈরি করেছে।
আর এর মধ্যেই গত সপ্তাহে আবারো ইস্ট লন্ড বরোর নির্বাহী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন লুৎফর রহমান।
২০০৮ সালে ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ ভূষিত এন্ড্রু গিলিগান তিন দিন আগে টেলিগ্রাফে তার ব্লগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও বিভেদমূলক গোষ্ঠীগত রাজনীতির চর্চাসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিবরণ তুলে ধরেছেন।
গিলিগান এসব অভিযোগের ৩০টি বিষয়ের একটি তালিকা দিয়েছেন, যার মধ্য থেকে চুম্বক বিষয়গুলি তুলে ধরা হলো:
# ২০০৮ সালে ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠী ইসলামী ফোরাম অব ইউরোপের প্রত্যক্ষ সহায়তায় টাওয়ার হ্যামলেটের নেতৃত্ব জিতে নেন লেবার পার্টির তৎকালীন কাউন্সিলর লুৎফর রহমান। উগ্রপন্থী এই সংগঠনটি ব্রিটেনে ‘ইসলামী সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চালু করতে চায়। একটি গোপন ভিডিওতে সংগঠনটির কর্মীরা কীভাবে কাউন্সিলের উপর তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা খাটিয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছে।
# আইএফই’র অঙ্গ সংগঠনগুলোকে লাখ লাখ পাউন্ড অনুদান দিয়েছেন লুৎফর। শুধু তাই নয়, অযোগ্য হলেও ওই সংগঠনের এক জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিজের সহকারী প্রধান নির্বাহী করেন তিনি। পরে তাদের দুজনকেই পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
# উগ্রপন্থী এক প্রচারককে তার কাউন্সিল চেম্বারে বক্তব্য দিতে আহ্বান জানান তিনি। আর টাওয়ার হ্যামলেটের পাঠাগারে উগ্রপন্থী প্রকাশনাসহ আল-কায়েদা নেতা আনওয়ার আল মালিকির অডিও টেপ পাওয়া যায়।
# টাওয়ার হ্যামলেটের মাত্র ৩৪ শতাংশ মুসলিম হলেও লুৎফর তার পরিষদে শতভাগ বাংলাদেশি ও মুসলিমকে নিয়োগ দেন।পরিষদের কোনো কখনো কোনো অমুসলিমকে নিয়োগ দেননি। কাউন্সিলর হিসেবেও কোনো অমুসলিম নিয়োগ পায়নি।
# আইএফই’র একটি অঙ্গ সংগঠনের সাবেক কর্মচারী আলিবর চৌধুরীর হাতে কাউন্সিলের অর্থের পুরো নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন। আলিবরের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় বিভিন্ন অভিযোগ আছে।
# লুৎফর ও আলিবরের অধীনে পুরো কমিউনিটির সেবায় বরাদ্দ থাকা অর্থ সরিয়ে আইএফই’র অঙ্গ সংগঠন ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে বরাদ্দ দেয়া হয়, যারা প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে।
# প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে কাউন্সিলের মূল্যবান সম্পদ নিজের ঘনিষ্ট সহযোগীদের কাছে বিক্রি করে দেন লুৎফুর।
# লুৎফরের সহযোগীদের ‘ভোট চাষ’ করতে দেখা গেছে। তারা মানুষকে পোস্টাল ভোটার হিসেবে নাম লিখিয়ে তাদের কাছ থেকে ফাঁকা ব্যালট পেপার নিয়ে নিয়েছে।
# তিনি ভয়-ভীতির পরিবেশ তৈরি করে কাউন্সিল পরিচালনা করেন। আলিবর চৌধুরীসহ তার সহযোগীদের অনেককে তার বিরোধী সমকামীদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করতে দেখা গেছে।
# কাউন্সিলের বৈঠকে এসব অভিযোগের উত্তর দিতে সম্মত হননি লুৎফর। এমনকি নির্বাচনের সময়ও তাকে কোনো জনসভায় বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি, যেখানে তাকে জনতা তার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারতো।
# অ-বাঙালি গণমাধ্যমকে ব্যাপকভাবে এড়িয়ে গেলেও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাংলা ভাষার টিভি স্টেশনগুলোকে হাজার পাউন্ড দিয়েছেন লুৎফুর। এর বিনিময়ে ওই চ্যানেলগুলো তার পক্ষে প্রচারের কাজ করেছে।
# করদাতাদের অর্থ ব্যক্তিগত ব্যয়বহুল কাজে খরচ করেছেন লুৎফুর। জনগণের অর্থে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে নিজের ছবি ছাপিয়ে ঘরে ঘরে বিলি বিলি করেন তিনি। শুধু তাই নয়, বিলবোর্ড ও ল্যাম্পপোস্টসহ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় নিজের শত শত কপি ছবিও লাগিয়েছেন জনগণের অর্থেই।
# বরোর অ-মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি বিরূপভাবাপন্ন লুৎফর একটি ইতিহাস জাদুঘর বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এছাড়াও ইসলামের ধর্মীয় চেতনার বিরুদ্ধে আঘাত হানার কথা বলে পাব বিক্রি করে দেয়া, সেগুলো বন্ধ করার এবং হেনরি মুরের শিল্পকর্ম সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেন তিনি। একই সময় তিনি ধর্ম প্রচারে প্রকল্প তৈরি করে তাতে শত শত পাউন্ড অর্থ ঢালেন।
# লুৎফরের কাউন্সিলে শিক্ষা বিষয়ক সদস্য অলিউর রহমানকে প্রকাশ্যে সমকামিতার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে দেখা গেছে। তার ক্যাবিনেটের সংস্কৃতিবিষয়ক সদস্য সমকামী মানুষদের নিয়ে মশকরা করেন।
# তার ক্যাবিনেটের পরিবেশবিষয়ক সদস্য শাহেদ আলীর বিরুদ্ধে করফাঁকির অভিযোগ এবং লুৎফুরের প্রধান অর্থ যোগানদাতা হোটেল ব্যবসায়ী সিরাজের বিরুদ্ধে নকল ওয়াইন তৈরি করে বিক্রির অভিযোগ আছে।
# লুৎফুরের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তিনি কমুনিটি রাজনীতির মধ্যে বিভাজনের চর্চা করেন এবং কাউন্সিলের জনবল ও সম্পদের অপব্যবহার করেন।