মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নিজের সাফাই সাক্ষ্য সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ দিয়ে দুই দিন সময় বেঁধে দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। তবে এ সময়ের মধ্যে সাক্ষ্য শেষ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
Published : 23 Jun 2013, 12:28 PM
গত ১৭ জুন থেকে নিজের বিরুদ্ধে মামলায় প্রথম সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন বিএনপির এই নেতা।
রোববার বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ পঞ্চম দিনের মতো সাক্ষ্য দেন তিনি।
পঞ্চম দিনেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বক্তব্য নিয়ে প্রসিকিউশন বেশ কয়েকবার আপত্তি জানায়। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আইন নিয়ে তিনি কথা বলা শুরু করলে এতে আপত্তি জানায় ট্রাইব্যুনালও।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবীর বলেন, “আপনি তো অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে বলছেন, এটার তো আমরা অনুমতি দিবো না।”
প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, “উনি (সালাউদ্দিন কাদের) আইসিটি আইনের (অ্যাক্টের) বৈধতা চ্যালেঞ্জ করছেন। আদালতের কি এখতিয়ার আছে সংসদে পাশ হয়ে যাওয়া একটি আইন নিয়ে আলোচনা করার?”
তিনি আরো বলেন, “দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আজকে পর্যন্ত ১১টি সেশন ধরে উনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রাসঙ্গিক কী পেলাম আমরা?”
এরপর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, “মি. চৌধুরী, আপনি ফ্যাক্টে আসেন।”
পরে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “আমি ট্রাইব্যুনালের বাইরে যাবো না। আমাকে যে তিনটা প্যারামিটার দিয়েছেন তার বাইরে আমি কিছুই বলব না। এর আগে আপনারা আমাকে বাধা দিয়েছেন, আমি কি তর্ক করেছি?”
“আপনাদের কাছে আমি একটু ধৈর্য আশা করতেই পারি। আমার ধৈর্য থাকার কথা না, এখানে আমার জীবন বাঁচানোর জন্য দাঁড়িয়েছি।”
“আমার বিরুদ্ধে ফর্মাল চার্জ কতো বড় ছিল তা তো আপনারা দেখেছেন। শুধু ভূমিকাই ছিলো ১৬ পাতা। আমার জীবনের ৪২ বছরের কথা আপনারা জানতে চাচ্ছেন। এগুলো কোনোটাই অপ্রাসঙ্গিক নয়।”
তিনি ট্রাইব্যুনালের কোনো আইনে সময় সাক্ষ্যের সময় বেঁধে দেয়া রয়েছে কি না জানতে চেয়ে বলেন, “এই আইনের কোথাও কী সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে? দ্রুত বিচার আদালতের জন্য যেমন ৯০ দিন উল্লেখ আছে। ট্রাইব্যুনালে তেমন কোন টাইম ফ্রেম তো আইনের কোথাও নেই।”
“অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছে আড়াই মাস গেছে, রায় দেননি। কি করলেন? কোথাও কি টাইম দেয়া আছে? আপনি যদি বলেন, জবানবন্দি শেষ করে দেই। কালকে ফাঁসি দিয়ে দেন। আমি ডিপোজিশন দিচ্ছি যে তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে।”
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত ১৪ মে থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসেবে ৪১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামিপক্ষ তাদের জেরা করেছে।
গত ৪ এপ্রিল সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট ২৩টি অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এর আগের দিনের মতো পঞ্চম দিনেও তিনি খেলাফত আন্দোলন নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্র্রোহিতার মামলায় ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ২ মাস ২৪ দিন জবানবন্দি দেয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “তখন আমরা ছিলাম পরাধীন। আর একটি স্বাধীন দেশে জবানবন্দি মাত্র ১০ সেশন যেতেই খোটা দেয়া হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে দেড় বছর ধরে ৪১ জন সাক্ষী দিয়েছে। তার মধ্যে ২১ জন শোনা ওঁঝা (যারা শুনে সাক্ষী দিয়েছেন)।”
এ সময় চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা আপনার কথা শুনব, কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে।”
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ করে বলেন, “শাহবাগ চত্ত্বরের আওয়াজে ট্রাইব্যুনালের আইন পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আপিলে আটকে গেছে। আটজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মাত্র ৩৪ দিন বাকি আছে ২৫ অক্টোবরের। জানি কী হবে এই কেইসে।”
এ সময় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান আবারো বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শ দিয়ে জানতে চান তার সাক্ষ্য শেষ করতে কতদিন লাগবে।
জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “আমি বলতে পারবো না। আমাকে যে তিনটা প্যারামিটার নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে সে তিনটা বিষয়ের বাইরে যাবো না।”
“আমার জীবন বিপন্ন। আমি কোথায় ছিলাম সেটা প্রমাণ করতে হবে। কোথায় ছিলাম না সেটা প্রমাণ করতে হবে না। আমি বিদেশ থেকে সাক্ষী আনতে চাই। এবং পরোয়ানা প্রয়োজন। পরোয়ানা জারির পরে আমার সাক্ষীদের হাজির করবো।”
সাফাই সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়া হয়েছে কি না ট্রাইব্যুনাল তা জানতে চাইলে জমা দেয়া হয়নি বলে জানান প্রসিকিটর সুলতান মাহমুদ সীমন।
এর জবাবে সালাউদ্দিন বলেন, “দিয়েছি। আমি কি নির্দিষ্ট চারজনের নাম দিব যাতে ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। আমার সাক্ষী যে কলকাতার জেলে পাওয়া যাবে না তার নিশ্চয়তার কী?”
পরে রোববার মধ্যাহ্ন বিরতির পর জবানবন্দি অসমাপ্ত অবস্থায় মামলার কার্যক্রম সোমবার পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়। তবে তাকে দুই দিনের মধ্যে তার জবানবন্দি শেষ করার তাগিদ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
অবশ্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালতে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি পারবেন না।
এদিকে মধ্যাহ্ন বিরতির জন্য আদালতে মুলতবি হওয়ার পর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমনকে উদ্দেশ করে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, সীমন সাহেব, ২৫ অক্টোবরের আগে আমাকে ফাঁসি দিতে পারবেন?
জবাবে প্রসিকিউটর ‘না’ সূচক অভিমত দিলে তিনি বলেন, “আমাকে দেয়া সম্ভব না হলে আর কাউকে ফাঁসি দেয়া সম্ভব না।”
রোববার সাক্ষ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “রাজনৈতিক জুলুমবাজী বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি পেশাগত ঝুঁকি। ১/১১ এর পরে দেশের জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়।”
“সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুইবার দেশে ফিরতে বাধা দেয়া হয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (তৎকালীন) যেতে বাধ্য করা হয়।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়েছে- তা প্রমাণ করার একটি নগ্ন অপচেষ্টা ছিলো এটি। এ অপবিত্র প্রচেষ্টায় সমাজের একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্রেণি জড়িত ছিল যারা গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এ শ্রেণিতে ছিল গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ এবং কিছু প্রশ্নবিদ্ধ নীতিসম্পন্ন কিছু আইনজীবী।”
সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “গণমাধ্যমের এ সিন্ডিকেটটির নেতৃত্ব দেয় ‘দি দিল্লি স্টার’ নামের একটি জনপ্রিয় ‘র্যাগ শিট’। আইনজীবীদের নেতৃত্ব দেয় দ্বিজাতি তত্ত্ব থেকে উৎসারিত সংবিধান বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের নিয়ে গঠিত মঈনউদ্দিন সরকারের নেতা ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন খান, যিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশে হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছেন।”