নারায়ণগঞ্জে হেফাজতকর্মীদের মহাসড়ক অবরোধের সময় সংঘর্ষে বিজিবি ও পুলিশের তিন সদস্যসহ অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন।
Published : 06 May 2013, 05:16 AM
পুলিশের পক্ষ থেকে আট জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করা হলেও বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ১৪ জন নিহত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক।
মতিঝিল থেকে সরতে বাধ্য হওয়া হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা সোমবার সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড, সানারপাড় ও কাচপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে এবং গাড়ি ভাংচুর শুরু করে বলে স্থানীয়রা জানায়।
রোববার ঢাকা অবরোধের পর মতিঝিলে টানা অবস্থানে বসলে ভোররাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে হেফাজতকর্মীদের তুলে দেয়।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “হেফাজতকর্মীরা ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে কিছু দুষ্কৃতকারীকে নিয়ে মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে ভাংচুর চালায়। বিজিবি ও পুলিশ অবরোধ সরানোর সময় তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় তারা।”
পুলিশ জানায়, হেফাজতকর্মীরা বাঁশ ও গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করে। এ সময় তারা সড়কে পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা দুটি বিআরটিসি বাসসহ চারটি গাড়িতে আগুন দেয় এবং ৮/১০টি যানবাহন ভাংচুর করে।
সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় সকালে পুলিশ ও বিজিবির ছয় সদস্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক।
তারা হলেন- বিজিবির সদস্য শাহ আলম, পুলিশের কনস্টেবল জাকারিয়া ও নায়েক ফিরোজ।
আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান বিজিবির মহাপরিচালক আজিজ আহমেদ, সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
দুপুরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটি কভার্ড ভ্যানের চালকের সহকারী মিজানুর রহমান (১৬) এবং পথচারী মাজহারুল ইসলামকে (২৮) ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরও মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল।
ওই ভ্যানের চালক আজীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে রাস্তার পাশে ভ্যানটি দাঁড় করিয়ে মিজানকে নিয়ে তিনি তা মেরামত করছিলেন। এর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে মিজান গুলিবিদ্ধ হন।
সংঘর্ষে নিহত আরো দুজনের লাশ গেছে নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরে অবস্থিত ২শ’ শয্যার হাসপাতালে।
ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাজিমউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত মাসুম (৩২) ও আব্দুল হান্নান (৩০) নামে দুই পোশাক শ্রমিকের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা নিয়ে যায়।
ওই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সকাল থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত পুলিশ তিন দফা তাদের কাছে তিনটি লাশ রেখে গেছে, যাদের পরিচয় তাদেরকে জানানো হয়নি।
মঙ্গলবার লাশ তিনটির ময়নাতদন্ত হবে বলে তাদেরকে জানিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লার মৃত আবুল হাশেমের ছেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের সমবায় সুপার মার্কেটের ফাহিম ফ্যাশনের কর্মচারী সাইফুল (৩৬), একই মহল্লার আলী আহম্মেদের ছেলে সিএনজিচালক জসিমউদ্দিন (৩২) ও মাদানী নগরের আবদুল খালেকের ছেলে ব্যবসায়ী পলাশের (২৫) লাশ তাদের স্বজনরা নিয়ে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করেছে।
নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল মোড়ের মা মেডিকেল অ্যান্ড ল্যাবের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আবদুল কাইউম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সংঘর্ষে নিহত অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির লাশ রয়েছে তাদের হাসপাতালে।
গুলিবিদ্ধ আরো কয়েকজনকে তারা চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
তবে বিজিবি ও পুলিশের তিন সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিহত দুজন ও খানপুর হাসপাতালে থাকা অজ্ঞাত তিনটি নিয়ে মোট আট জন নিহতের তথ্য পুলিশের কাছে রয়েছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর বাইরে মৃতের আরো দুই/একজনের বেশি হবে না।”
সংঘর্ষের সূত্রপাত বর্ণনা করে পুলিশ সুপার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অবরোধকারী হেফাজতকর্মীদের সকাল ৭টার দিকে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা সরাতে গেলে তারা হামলা হয়। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে কাঁদানে গ্যাস এবং পরে গুলি ছোড়া হয়।
এসময় বিজিবির দুটি, পুলিশের একটি ও র্যাবের একটি পিকআপভ্যানে এবং একটি তেলের ট্যাংকারসহ মোট আটটি গাড়িতে আগুন দেয় হামলাকারীরা।পুড়িয়ে দেয়া হয় ট্রাফিক পুলিশের একটি ফাঁড়িও। ভাংচুর করা হয় অর্ধশতাধিক যানবাহন।
পুলিশ সুপার দাবি করেন, হেফাজতকর্মীদের সঙ্গে শিবির ও বিএনপির কর্মীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলায় অংশ নেয়।
সংঘর্ষে পুলিশ ১০ হাজারের বেশি রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি ছুড়েছে। এছাড়া শতাধিক টিয়ার শেলও নিক্ষেপ করা হয়েছে।
সকাল ১০টার দিকে হেফাজতকর্মীরা মহাসড়ক থেকে সরে গেলেও বিভিন্ন গলি থেকে পুলিশ ও বিজিবির ওপর ঢিল ছোড়া চালিয়ে যায়। দুপুর পর্যন্ত এই অবস্থা চলার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। এর মধ্যে আহত বিজিবি সদস্য লাভলু, পুলিশের এসআই সুলাইমান ও পান্নু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আহত ২০ জন খানপুরের ২শ’ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান ডা. নাজিম।এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছেন অনেকে।