জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
Published : 21 Feb 2013, 09:28 AM
বৃহস্পপতিবার প্রজন্ম চত্বরে লাখো মানুষের সমাবেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে শাহবাগে ১৭ দিনের টানা অবস্থান কর্মসূচির কার্যত সমাপ্তি ঘটল।
নতুন কর্মসূচির ঘোষণায় টানা অবস্থানের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য ছিল না গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শাহবাগ মোড়ে অবস্থান না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী সড়কে অবস্থান নিয়ে ছয় দফা দাবিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গণস্বাক্ষর অভিযান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে।
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হবে, বিকাল ৩টা থেকে হবে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
তবে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিটি রায়ের আগের দিন বিকাল ৩টা থেকে প্রজন্ম চত্বরে সমাবেশ চলবে।
আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে ইমরান মহাসমাবেশে বলেন, “গণমানুষের এই জাগরণ বৃথা যেতে দেয়া হবে না। প্রজন্ম চত্বর জেগে আছে, জেগে থাকবে।”
জামায়াত নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি ২৬ মার্চের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
পাশাপাশি গণজাগরণমঞ্চের কর্মী আহমেদ রাজীব হায়দারসহ জামায়াত-শিবিরের হত্যাকাণ্ডের শিকার সবার খুনিদের আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তারের সময়সীমা সরকারকে বেঁধে দেয়া হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে ক্ষোভ থেকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে একদল তরুণের অবস্থান কর্মসূচি দেশব্যাপী গণজাগরণের সৃষ্টি করে।
যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট এই প্রতিবাদ দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়ার পর আইন সংশোধন করে সরকার ও আসামি পক্ষের আপিলের সমান সুযোগের বিধান যোগ করা হয়।
আন্দোলনকারী একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবিও তোলে।
সংশোধিত আইনে কোনো দল বা সংগঠনের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিধানও যোগ হয়, যা দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের পথ খুলেছে।
গণজাগরণ মঞ্চ একে আন্দোলনের অর্জন হিসেবেই দেখছে।
ইমরান তার বক্তব্যে বলেন, “ইস্পাতকঠিন আন্দোলনের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
যুদ্ধাপরাধী দলের অর্থ যোগানদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
গণমানুষের নিরাপত্তায় জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালানোর দাবি জানানো হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীবকে জামায়াত-শিবির হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক এবং হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে আন্দালনকারীরা।
শাহবাগের পাশাপাশি রাজধানী কয়েকটি স্থানে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি রায়ের বাজার বধ্যভূমিকে সমাবেশ ও শপথ পাঠ হবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্করে, ২৭ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল শাপলা চত্বরে, ৩ মার্চ বাহাদুর শাহ পার্কে এবং ৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীতে সমাবেশ হবে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ও প্রতিবাদী গান করবে গণজাগরণ মঞ্চ।
আগামী ১ মার্চ সারা বাংলাদেশের জাগরণ মঞ্চে প্রতিবাদী গান হবে। ১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ প্রতিটি বিভাগে গণজাগরণ মঞ্চে সংহতি সমাবেশ হবে।
প্রতি শুক্রবার সব গণজাগরণ মঞ্চে ৩টা থেকে সমাবেশ চালাতে বলা হয়েছে।
২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত দেশ ও দেশের বাইরে গণস্বাক্ষর অভিযান চলবে। পরে তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।
২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুমার নামাজের পর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে জামায়াত-শিবিরের হাতে নিহত সবার জন্য মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠান করতে বলা হয়েছে। একই দিন অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রার্থনা হবে।
উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল, দক্ষিণে টিএসসি, পূর্বে রমনার ফটক, পশ্চিমে কাঁটাবন পর্যন্ত বিস্তৃত এই সমাবেশে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে বক্তব্য দিতে দাঁড়ান ইমরান।
২০ মিনিটের বক্তব্যে তিনি আন্দোলনে অটল অবস্থানের প্রত্যয় ঘোষণার পাশাপাশি নতুন কর্মসূচিগুলো জানিয়ে দেন।
ইমরানের আগে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা। এই সমাবেশ শুরু হয় ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে।
মাওলানা মেহেদী হাসান কুরআন তিলওয়াত করেন, এরপর গীতা পাঠ করেন সাধন চক্রবর্তী, ত্রিপিটক পাঠ করেন অধ্যাপক বিমান বড়ুয়া, বাইবেল পাঠ করেন মাইকেল এইচ শাহ।
ধর্মীয় বাণীর পর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, যাতে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মেলায় গোটা সমাবেশ। এরপরই গাওয়া হয় একুশের গান ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই সমাবেশে ভাষাশহীদরা একাকার হয়ে যান তাদের উত্তরসূরি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মধ্যে।
পূর্বসূরিদের স্মরণে নতুন প্রজন্ম যেমন গান গেয়েছিল ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো...’, তেমনি স্লোগান ধরেছিল ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগারসহ কয়েকজন তরুণের প্রতিবাদী অবস্থানের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল, তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজারো মানুষের সমাবেশে রূপ নিয়েছিলে।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে যোগ হয় নতুন নতুন মুখ, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে শাহবাগে।
ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ইমরান বলেন, “৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ঠিকানা এ শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ৪২ বছরের জমানো ঘৃণা, ক্রোধের গগন বিদারি আওয়াজ উঠেছে স্লোগানে স্লোগানে।”
শাহবাগের এই আন্দোলনকে তরুণ প্রজন্মের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন এই চিকিৎসক। এই আন্দোলনে সংহতি জানাতে ছুটে আসা মুক্তিযোদ্ধারাও একে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলছেন।
ইমরান বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জয় বাংলা স্লোগানে আবার স্বাধীনতার চেতনায় একাকার হয়ে অলঙ্কৃত হয়েছে একাত্তর। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।”
জাগরণের এই ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মকেও পথ দেখাবে বলে মনে করেন তিনি।
সব অপপ্রচার কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে লড়াই চালানোর প্রতিজ্ঞা করেন তিনি।
এখানে আন্দোলনের শেষ নয়, তাও ইমরান বলে দেন সবাইকে।
“এখানেই সন্তুষ্ট হয়ে থেমে থাকব না আমরা। লক্ষ্য অনেক দূর। যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিতে হবে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির চির বিদায় জানানোর লক্ষ্যে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।”