দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রাণঘাতী নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ জনের মৃত্যুর পর সংক্রমণ রোধে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পাশাপাশি রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা
Published : 28 Jan 2012, 05:06 AM
দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রাণঘাতী নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ জনের মৃত্যুর পর সংক্রমণ রোধে খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার পাশাপাশি রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালের পর থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত ২০১ জনের মধ্যে ১৫৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মাহমুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খেজুরের রস খাওয়া বন্ধ রাখাসহ কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক হলে এ রোগ সহজেই এড়ানো সম্ভব। তবে একবার আক্রান্ত হলে নিরাময়ের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই।”
“এ রোগ ব্যাপক মাত্রায় প্রাণঘাতী। এ বছর আমরা যে কয়জনের মধ্যে সংক্রমণের খবর পেয়েছি তাদের সবাই মারা গেছে”, যোগ করেন তিনি।
চিকিৎসকরা জানান, নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমে প্রচণ্ড জ্বর, মাথাব্যথা, খিচুনি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এক পর্যায়ে রোগীরা প্রলাপ বকতে শুরু করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমণের পর একজন থেকে আরেকজনের মধ্যেও ছড়াতে পারে এই রোগ।
নিপা সংক্রমণের একমাত্র দেশ
সর্বপ্রথম নিপা ভাইরাস সনাক্ত করা হয় ১৯৯৮ সালে, মালয়েশিয়ায়। তবে বর্তমানে বালাদেশকে এ রোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেই এখন বিশ্বে একমাত্র দেশ, যেখানে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে এ রোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকাতেও এ ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলেও এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
এ বছর নিপা ভাইরাসে পাঁচ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে আইইডিসিআর বলেছে, জয়পুরহাটের সদরপাড়া ও ক্ষেতলাল উপজেলায় মানবদেহে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এছাড়া আরো কয়েকজনের মধ্যে এ রোগ সংকমণের খবর পাওয়া গেছে।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আরো অন্তত পাঁচজন নিপায় আক্রান্তের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।”
তবে এ রোগ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ায় অনেকেই এলাকা ছড়তে শুরু করেছেন বলে সিভিল সার্জন জানান।
আইইডিসিআরের একদল কর্মকর্তা এখন সংক্রমণ এলাকায় কাজ করছেন। এ প্রতিষ্ঠানের একজন মাঠকর্মী জানান, তারা অসুস্থ রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাচ্ছেন।
“খেজুরের কাঁচা রস না খাওয়ার জন্য সতর্ক করে আমরা লিফলেট বিতরণ করছি। এছাড়া মাইকেও এ ব্যাপারে প্রচার চালানো হচ্ছে”, বলেন তিনি।
বাদুড় থেকে মানুষে
আইইডিসিআরের বিশেষজ্ঞরা জানান, নিপা ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়।
এক গবেষণায় ইনফ্রারেড ক্যামেরায় তোলা ছবিতে দেখা যায়, রস খাওয়ার সময় বাদুড় অনেক সময় গাছের হাড়িতে মুত্রও ত্যাগ করে।
সেই বাদুড় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে এ রোগ।
আইইডিসিআরের পরিচালক মাহমুদুর রহমান জানান, ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফোটানো হলে খেজুরের রসের মাধ্যমে নিপা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে না।
“শীতকালে বাংলাদেশের মানুষের খেজুরের রস খাওয়ার অভ্যাস দীর্ঘদিনের। তবে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চাইলে আমাদের কাঁচা রস খাওয়া বন্ধ করতে হবে”, বলেন তিনি।
২০০৪ সালে ফরিদপুরে ২৭ এবং রাজবাড়ীতে ২৩ জনের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণাগারে পরীক্ষা করে বাংলাদেশে নিপা সংক্রমণের বিষয়টি প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হয়। এর আগে দেশে নিপা ভাইরাসে কতো জনের মৃত্যু হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে মানব দেহে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। গত বছরও লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় নিপায় আক্রান্ত হয়ে ২৮ জনের মৃত্যু হয়।
মাহমুদুর রহমান বলেন, “কেন বিশেষ কিছু জেলায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি তা আমরা বলতে পারবো না। তবে এ পর্যন্ত যেসব জেলার মানুষ এ রোগে আন্ত্রান্ত হয়েছে, সেসব স্থানে প্রচুর খেজুর গাছ আছে। খেজুরের রস সংগ্রহের প্রবণতাও ওইসব এলাকায় বেশি।”
উচ্চ মাত্রায় সংক্রামক
বিশেষজ্ঞরা জানান, বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমণের পর স্পর্শের মাধ্যমেও নিপা ভাইরাস অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে। ফরিদপুরে এ রোগে মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিপা আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক না হওয়ার কারণে সেবাদাতারও এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
একই বিছানায় শোয়া, রোগীর পোশাক পরিষ্কার করা, এমনকি নিপায় আক্রান্তের মরদেহের গোসলে নিয়োজিতরাও সতর্ক না হলে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন।
সতর্কতা
“তবে ঘন ঘন হাত ধোয়া, রোগীর পাত্র থেকে খাবার না খাওয়া এবং সেবা দেওয়ার সময় কমপক্ষে তিন ফুট থাকলে এ রোগ থেকে দূরে থাকা মোটেও কঠিন কিছু নয়”, বলেন অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান।
বিশেষজ্ঞরা জানান, রোগীর ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী ভালোভাবে পরিষ্কার না করে আবার ব্যবহার করা যাবে না। রোগীর পরিচর্যা করার পর হাত ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
জয়পুরহাটে নিপা উপদ্রুত এলাকায় আইইডিসিআরের স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।