শহীদুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
ঢাকা, মার্চ ৩১ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- পরিবেশ বান্ধব উপায়ে মাত্র আট ঘণ্টায় ইট তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি)।
এই প্রযুক্তিতে কোনো ধোঁয়া না উড়িয়ে একটি ইট তৈরিতে খরচ পড়বে সাড়ে তিন থেকে চার টাকা। প্রচলিত পদ্ধতিতে এই খরচ হয় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টাকা।
ইউএনডিপি 'ইমপ্রোভিং কিন ইফিসিয়েন্সি ফর দি ব্রিক মেকিং ইন্ড্রাস্টি ইন বাংলাদেশ' প্রকল্পের আওয়ায় 'হাইব্রিট হোফম্যান কিন' প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি কর্মশালায় এই প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ইউএনডিপির বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রতিনিধি স্টেফেন প্রিসনার।
তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রায় আট হাজার ইট ভাটা থেকে প্রতি বছর ছয় দশমিক চার মিলিয়ন টন কার্বনডাই অক্সাইড নির্গত হয়। এসব ইট ভাটায় কয়লা পোড়ানো হয় এক মিলিয়ন টনের বেশি।
এভাবে কয়লা পোড়ানো হলে ২০১৪ সালের মধ্যে ইট ভাটা থেকে আট দশমিক সাত মিলিয়ন টন কার্বনডাই অক্সাইড নির্গত হবে বলে জানান ইউএনডিপির এই প্রতিনিধি।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মেজবাউল ইসলাম বলেন, ইট ভাটার নির্গত কালো ধোঁয়া থেকে বায়ু দূষণ হচ্ছে। এটা জনস্বাস্থ্যে এবং ফসলের জন্যও ক্ষতিকর। নগরায়নের সঙ্গে দিন দিন ইটের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে দূষণের মাত্রাও।"
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে আরো সহায়তা দেওয়ার জন্য ইউএনডিপির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
কর্মশালায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনোয়ার ইসলাম ও হাইব্রিট হোফম্যান কিন'র প্রকল্প পরিচালক খন্দকার নেওয়াজ রহমান বক্তব্য দেন।
পরে ইট ভাটার মালিক, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
এতে হাইব্রিট হোফম্যান কিন'র প্রযুক্তির মেশিন প্রস্তুকারক চীনের জিয়াং রিসার্চ এন্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট অব ওয়াল এন্ড রফ ম্যাটেরিয়ালস-এর সভাপতি শিয়াও হুই বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
ধোঁয়া না উড়িয়ে যেভাবে তৈরি হয় ইট
ইমপ্রোভিং কিন ইফিসিয়েন্সি ফর দি ব্রিক মেকিং ইন্ডাস্ট্রি প্রকল্পের জনসংযোগ কর্মকর্তা শামীম ইফতেখার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মেশিনের সাহায্যে ৭০ শতাংশ মাটির সঙ্গে ৩০ শতাংশ গুড়ো কয়লা মেশানো হয়। এর সঙ্গে পানি মিশিয়ে তৈরি করা হয় মাটি ও কয়লার পেস্ট।
অন্য একটি মেশিনে এই পেস্ট দিয়ে বানানো হয় ১৬টি ইটের আকারে একটি খণ্ড। পরে তা ড্রাইং মেশিনে শুকানো হয়।
বড় ইট-খণ্ডকে শুকানোর জন্য ড্রাইং মেশিনে ব্যবহার করা হয় কালো ধোঁয়া। এই ধোঁয়া আসে ইট পোড়ানোর মূল চুল্লি থেকে।
শুকনো বড় ইট-খণ্ডটি মেশিনের সাহায্যে ১৬টি ইটের আকারে কেটে পোড়ানোর জন্য নেওয়া হয় চুল্লিতে। মাটির সঙ্গে ৩০ শতাংশ কয়লাগুড়ো মেশানো থাকায় চুল্লিতে অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যবহার করা হয় না। মাটির সঙ্গে মিশে থাকা কয়লাগুলোই পুড়ে ইটকে শক্ত করে। কয়লা পুড়ে গেলেও ইটের আকারের কোনো পরিবর্তন হয় না বলে জানান তিনি।
শামীর ইফতেখার বলেন, ইট পোড়ানোর এই চুল্লিতে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় তা ব্যবহার করা হয় ড্রাইং চেম্বারে। আর ড্রাইং চেম্বারের ধোঁয়া সংরক্ষণ করে পরে তা আবারো ব্যবহার করা হয়। ড্রাইং চেম্বার চুল্লি দুটোই বায়ু প্রতিরোধক হওয়ায় ধোঁয়া বাইরে বের হতে পারে না।
এভাবে আট থেকে নয় ঘণ্টার মধ্যেই ইট তৈরি করা যায়। রোদে শুকানোর ঝামেলা এবং খোলা মাঠে চিমনি ব্যবহার না করে বৈরী পরিবেশেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট তৈরি করা যায় বলে জানান তিনি।
লোপ পাবে ১৫০ বছরের পুরনো পদ্ধতি
হাইব্রিট হোফম্যান কিন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ইট তৈরির ১৫০ বছরের পুরানো পদ্ধতি লোপ পাবে বলে আশা করছে ইউএনডিপি।
সংস্থাটির বাংলাদেশ আঞ্চলিক প্রতিনিধি স্টেফেন প্রিসনার বলেন, পরিবেশ বান্ধব এই প্রযুক্তি ব্যবহারে খরচ এবং সময় উভয়ই কমে যাবে। ইট ভাটার মালিকরা সহজেই প্রযুক্তিটি গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
হাইব্রিট হোফম্যান কিন'র প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার নেওয়াজ রহমান জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি ইট তৈরি করতে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৬ দিন। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে কাজ বন্ধ রাখতে হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে ইট ভাটাগুলোতে 'ফিক্সড চিমনি' ব্যবহার করে ইট তৈরি করা হলেও তা পরিবেশ বান্ধব নয়। পুরনো পদ্ধতিতে ইট তৈরির খরচও বেশি হয়।
এমতাবস্থায় হাইব্রিট হোফম্যান কিন প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেড়শ বছরের পুরনো পদ্ধতি লোপ পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
খরচপাতি
একটি ইট ভাটার জন্য শুধু মেশিন কেনার খরচ পড়বে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। আর এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুরো ইট ভাটা প্রস্তুত করতে খরচ হবে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা।
সাভার, গাজীপুর ও ধামরাইয়ের তিনটি ইট ভাটায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট তৈরি করা হচ্ছে। আরো সাতটিতে মেশিন বসানোর কাজ চলছে বলে জানান এই প্রকল্পের জনসংযোগ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহারে ইউএনডিপি ইট ভাটার মালিকদের কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না। তবে জাতিসংঘের 'গ্রিন ফান্ড' এর আওতায় প্রকল্পটি পরিচালিত হওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে সহায়তা দেবে ইউএনডিপি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এসআই/কেএমএস/১৫৫৬ ঘ.