মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে ভিটেমাটি আর সহায়-সম্বল হারানোর ভয়ানক অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশে আসা অনেকে লাখো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে ফেলছেন শিশু সন্তানকে।
Published : 17 Sep 2017, 01:40 AM
কোনো কোনো শিশু বাবা-মায়ের কোলে ফিরলেও নিখোঁজ থাকছে অনেকে। সন্তানহারা বাবা-মা আর তাদের ঠিকানা না জানা শিশুরা সময় পার করছে চোখের জলে।
এ রকম চোখের জলে ভেসেছিলেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নুরুল্লাপাড়ার বাসিন্দা রাজিয়া আক্তার ও সোনা মিয়া। তারা জন্মভূমি মিয়ানমার ছেড়েছেন ১০ সেপ্টেম্বর। ঝুপড়ি ঘর বেঁধেছেন নতুন গড়ে তোলা কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে।
শুক্রবার সোনা মিয়া প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জুমার নামাজে যাওয়ার। এদিকে রাজিয়া বেগম রিলিফের চাল ফুটিয়ে ছেলে-মেয়েদের পাশে রেখে চুলায় তরকারি চড়িয়েছেন। রান্না শেষ করে গোসলে নিয়ে যাবেন বাচ্চাদের, অন্তত ছোট্ট ছেলে ছগিত উদ্দিনকে।
দুই বছর পার করা ছগিতের শরীরটা ভালো না। দেখা দিয়েছে নানা চর্মরোগ। বাংলাদেশে আসার পথে এবং আসার পর এতদিনে ঠিকঠাক করে গোসলও দিতে পারেননি। তার জন্য তাই অন্য রকম তাড়না কাজ করছে মায়ের মনে।
রান্না শেষ করেই ছুটতে হবে পানির সন্ধানে। পানি মিললে ছেলেকে নিয়ে যাবেন গোসলে। আর সব কাজই শেষ করতে চান স্বামী নামাজ শেষ করে আসার আগে।
ছোট্ট ছগিত একটু একটু করে ভাত খাওয়াও শিখেছে। সেটা নিয়েও একটা উত্তেজনা রয়েছে। হঠাৎ খেয়াল হল যাকে নিয়ে এত ব্যস্ততা, সেই ছগিতই পাশে নেই। অথচ একটু আগেই আপন মনে খেলছিল সে।
প্রথমে আশপাশে খোঁজেন, নাম ধরে ডাকাডাকিও করেন। কিন্তু কোনো সাড়া নেই ছেলের। সময় যতই গড়াচ্ছিল, ততই পাগল হয়ে উঠছিলেন মা। ঘর-বাড়ি, সহায় সম্বল হারিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে শরণার্থী হয়ে আসা মা মানতে পারছিলেন না সন্তান হারানোর বাস্তবতা।
দুই ঘণ্টা হন্যে হয়ে খোঁজার পর তিনি হাঁটা ধরেন নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের গেইটের দিকে। সেখানে নাকি কেউ হারালে ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। নিজের ঘর থেকে পায়ে হাঁটা পথে প্রায় ২৫ মিনিটের দূরত্বে ওই ঘোষণা মঞ্চে আসতে আসতেই একটি ছোট্ট বাচ্চা পাওয়ার ঘোষণা তার কানে বাজে।
ছুটতে ছুটতে মঞ্চে এসে দেখেন, ছেলেটা তার প্রিয় ছগিত নয়। মাইকের আওয়াজ থামতেই শুনতে পান পরিচিত কান্না। কয়েক হাত দূরে কান্নার উৎসের দিকে তাকাতেই চমকে উঠেন মা, এইতো তার নাড়ি ছেড়া ধন!
মঞ্চের ঘোষক জানান, ছেলেটি কোথাও থেকে নিজে নিজেই ঘোষণা মঞ্চের সামনে এসে কাঁদতে থাকে। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন তাকে মঞ্চের টেবিলে তুলে দেন। কিন্তু সেখানে শিশুটিকে কিছুতেই স্থির রাখা যাচ্ছিল না। তীব্র কান্না আর ছটফট করে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল সে।
অনেক চেষ্টার পর শান্ত করতে না পেরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, রাখা হয় দৃষ্টি। হয়ত ছেলেটি নিজে নিজেই ঘরের দিকে পা বাড়াবে। তখন একজন তাকে অনুসরণ করবে। হয়ত পাওয়া যাবে তার পরিবারের সন্ধান। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পর বেশি দূর না গিয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদতে থাকে সে। এর মাঝেই মা নিজেই এসে হাজির হয়।
এত দূরের পথ কীভাবে এই ছোট্ট শিশু এসেছে, সেটা স্পষ্ট নয় রাজিয়ার কাছেও। সেটা এখন আর গুরুত্বপূর্ণও নয় তার কাছে। ছেলেকে ফিরে পাওয়াই তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে।
তবে আসমার বাবা মো. রফিকের ভাগ্য রাজিয়া বেগমের মতো নয়। বৃহস্পতিবার যখন তার সাথে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি হন্যে হয়ে মেয়েকে খুঁজছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর তার মেয়ে হারিয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা তিনি মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
প্রথম সন্তানের খোঁজে তিনি ত্রাণের পেছনেও ছোটা বন্ধ করে দিয়েছেন, যার ফলে উপোষ করতে হচ্ছে অন্য ছেলে-মেয়েদের। কিন্তু বাবা খুঁজে চলেছেন তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে। পরিচিত-অপরিচিত কেউ তার দিকে তাকালেই তিনি জিজ্ঞেস করছেন মেয়ের কথা।
হারিয়ে যাওয়া সেই ভাইয়ের খোঁজ মেলেনি। এরপর শফিউল পাশে পায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে, তারাও খোঁজ করছে তার ভাইয়ের। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত সেই খবর মেলেনি।
শিশুদের হারিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা ঘটছে অহরহ। রাস্তায় যেতে যেতেই এমন অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, যাদের পরিবারের সদস্যরা হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে যাওয়া এই মানুষদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি।
হারিয়ে যাওয়াদের খবর নিতে গিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পে পাওয়া গেল হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের নিরাপত্তারক্ষী কামাল হোসেনকে। হঠাৎ করে উপচেপড়া লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে অনেক শিশু হারিয়ে যাচ্ছে-এমনটা দেখে তিনি নিজের উদ্যোগে মাইক ভাড়া করে ঘোষণা দেওয়ার কাজ শুরু করেন।
একটা সময় পর ইউএনএইচসিআর তাকে মাইক সরবরাহ করে। তার অফিস থেকে এই কাজের জন্য তাকে নিয়মিত দায়িত্ব থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে।
কামাল জানান, উভয় রকম মিলিয়ে ৫ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪১০টি শিশুর বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এই মঞ্চ থেকে। এদের মধ্যে ১২৯টি শিশুকে স্বজনদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে পরিবারের সদস্যরা অন্যভাবেও অনেককে খুঁজে পেতে পারেন জানিয়ে তিনি বলেন, “তারপরও বলা যায় অনেকেরই এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কারণ তারা এসে আমাদের কাছে নিয়মিত নতুন কোনো শিশুকে পাওয়া গেছে কি না সে খবর নেয়। তাছাড়া বেশ কয়েকদিন যাবত নিখোঁজ থাকার পর অনেকের স্বজনরা এখানে ঘোষণার জন্য এসেছেন। এটা দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা বোঝা যায়।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রেডক্রসের হেড অব দ্য ডেলিগেশনের পরামর্শক শিরিন সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে আমরা কাজ করছি। মিয়ানমারে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগে টেলিফোন সেবা দিয়ে থাকি।
“এখানে এসে হারিয়ে যাওয়াদের নিয়েও আমরা ডেটাবেজ তৈরি করব, সবার সাথে সমন্বয় করে এ রকম শিশুদের খুঁজে পেতে আমরা পদক্ষেপ নেব।”