যা আছে কপিরাইট আইনের খসড়ায়

আইন ভঙ্গের শাস্তি বাড়ানোর পাশাপাশি লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি যুক্ত করে কপিরাইট আইন সংশোধনের একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে কপিরাইট অফিস। 

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2017, 03:45 AM
Updated : 26 August 2017, 03:48 AM

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কপিরাইট বোর্ডের প্রধান মসিউর রহমান জানিয়েছেন, শিগগিরই এই খসড়া ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছেন তারা। আইন মন্ত্রণালয়ের সবুজ সংকেত পেলেই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।

২০০০ সালে প্রণীত কপিরাইট আইন ২০০৫ সালে এক দফা সংশোধনের পর এক যুগ পেরিয়ে যাওয়ায় সরকার সম্প্রতি আইনটি যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ যেসব সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই সংশোধিত খসড়াটি তৈরি করা হয়েছে বলে মসিউর রহমান জানান।

তিনি বলেন, লোকজ্ঞান ও লোকসংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি নতুন করে খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংগীত বিষয়ক কপিরাইটের ক্ষেত্রেও কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

এছাড়া কপিরাইট ও অন্যান্য অধিকার লঙ্ঘনে পুনঃঅপরাধের শাস্তি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। চলচ্চিত্রে কপিরাইট লঙ্ঘনের অপরাধকে আপসযোগ্য করার সুপারিশ রাখা হয়েছে।

এছাড়া পাইরেসি প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান যুক্ত করারও প্রস্তাব রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায়।

সংজ্ঞায় পরিবর্তন

প্রস্তাবিত এই খসড়া আইনে পরিণত হলে ‘কপিরাইট আইন ২০১০’ এর নাম বদলে হবে ‘কপিরাইট আইন ২০১৭’।

এ খসড়ায় অর্থনৈতিক অধিকার, নৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, সম্পাদক, পাবলিক ডোমেইন, লোকজ্ঞান, লোকসংস্কৃতি ও কম্পিউটার কর্ম (ডিজিটাল ওয়ার্ক) এর অধিকার সম্পর্কিত সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে নতুন করে।

সেখানে বলা হয়েছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধারাবাহিকভাবে মৌখিক, লিখিত বা অনুরূপভাবে প্রচলিত লোক-মেধা, লোক- তথ্য, লোক-কৃষ্টিকে ‘লোকজ্ঞান’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। পাশাপাশি মূর্ত ও বিমূর্ত লোক উপাদান ও লোক অভিব্যক্তিকে ‘লোক সংস্কৃতি’ হিসেবে দেখা হবে। বাংলাদেশে বসবাসকারী সব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

ডিজিটাল সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনে এবার ‘প্রণেতা’ হিসেবে এর সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে। কম্পিউটার প্রোগ্রামের নতুন সংজ্ঞায় এর অন্তর্ভুক্ত তথ্য-উপাত্ত, সোর্স কোড, সারণি, চার্ট, গ্রাফ, শব্দ-ধ্বনি, চিত্র, চলমান চিত্র, নকশা, টেক্সট, নির্দেশনা, সংকেত এবং এ ধরনের প্রোগ্রাম ব্যবহার করার ম্যানুয়ালকেও বোঝাবে।

কপিরাইট বোর্ডের সদস্য বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, “ডিজিটাল সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে প্রণেতা কে হবেন, এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাই এতদিন ছিল না, এবার সেই ব্যাখ্যায় সফটওয়্যার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করতে পারবে বোর্ড।”

কপিরাইটের স্বত্ব এবং মালিকদের অধিকার

কপিরাইটের স্বত্ব এবং মালিকদের অধিকার বিষয়ে কম্পিউটার-ডিজিটাল কর্ম, চলচ্চিত্র, সংগীত সম্পর্কে নতুন নির্দেশনা এসেছে এবারের খসড়ায়।

সেখানে বলা হয়েছে. জাতীয় সংগীত, দেশাত্মবোধক ও ধর্মীয় সংগীত (হামদ, নাত, গজল, কীর্তন, ক্যারল ইত্যাদি) এর কথা, সুর ও মিউজিকের প্যারোডি ব্যবহার করা যাবে না।

কম্পিউটার-ডিজিটাল কর্মের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে কোনো চুক্তি ছাড়া এই কর্ম সম্পাদনকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কপিরাইট দাবি করতে পারবেন না।

চলচ্চিত্র প্রযোজককে স্বত্বাধিকারী বিবেচনা করে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র বা চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য ও গল্প ব্যবহার করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে।

কপিরাইট বোর্ড

ছয় সদস্যের কপিরাইট বোর্ড গঠনের নিয়ম বহাল থাকলেও এবারের খসড়ায় ওই কমিটিতে একজন কপিরাইট বিশেষজ্ঞ রাখার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।

সুপারিশ অনুযায়ী, এবারও বোর্ডের প্রধান হবেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। আর রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইট হবেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কেউ। ২০১৬ সাল থেকে এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন উপসচিব জাফর রাজা চৌধুরী।

বোর্ডের বৈঠকে ছয় সদস্য উপস্থিত না থাকলে কোরাম পূর্ণ হবে না বলে যে বিধান এতদিন ধরে চলে আসছে, সংশোধিত আইনের খসড়ায় তা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

আগারগাঁওয়ে কপিরাইট অফিস

সেখানে বলা হয়েছে, কপিরাইট বোর্ডের সভাপতির উপস্থিতিতে ন্যূনতম দুই জন সদস্য উপস্থিত থাকলেই কোরাম পূর্ণ হবে।

আইনের ১২ নম্বর ধারায় নতুন উপধারা যুক্ত করে কপিরাইট বোর্ডের ক্ষমতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে কোনো ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন দেখা গেলে বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।

এর আগে বোর্ডকে ফৌজদারি ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় কপিরাইট অফিসকে দেওয়ানি আদালতের মত কাজ করতে বলা হয়েছে।

অপরাধ ও শাস্তি

কপিরাইট বা অন্যান্য অধিকার লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়।

চলচ্চিত্র ছাড়া অন্য যে কোনো সৃজনকর্মের কপিরাইট লঙ্ঘন করলে বা করতে সহায়তা করলে আগের মতই ছয় মাস থেকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে খসড়ায়।

প্রথমবার শাস্তি পাওয়ার পর আবারও আইন ভাঙলে দ্বিতীয় এবং পরবর্তী প্রত্যেক বারের অপরাধের জন্য এক থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান করার কথা বলা হয়েছে। আগে এই শাস্তি ছিল ছয় মাসের কারাদণ্ড।

খসড়ায় বলা হয়েছে, কপিরাইট লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হয়নি বলে আদালতে প্রমাণিত হলে সেক্ষেত্রে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে।

আর চলচ্চিত্রের কপিরাইট লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আগের মতই এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখতে বলেছে কপিরাইট বোর্ড।

এছাড়া রেজিস্ট্রারে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য উপস্থাপন, প্রতারিত বা প্রভাবিত করার জন্য মিথ্যা বিবৃতি দেওয়াসহ অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে খসড়ায়।

কোনো প্রকাশক বিধি লঙ্ঘন করলে খসড়ায় ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে, যা আগে এক হাজার টাকা ছিল। কোনো বই  বা সাময়িকীর ক্ষেত্রে কপিরাইট লঙ্ঘন হলে ওই বই বা সাময়িকীর মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডও আদালত দিতে পারবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, কপিরাইট অফিস লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে যে কোনো অবৈধ সম্প্রচার বন্ধ করার ক্ষমতা রাখবে। কপিরাইট লঙ্ঘন বন্ধে সরকার ‘উপযুক্ত সংখ্যক’ সদস্য নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবে।

কপিরাইট সমিতি

কপিরাইট অফিসে নিবন্ধিত সমিতির মেয়াদ বিদ্যমান আইনের মতই পাঁচ বছর করার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। এই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে নির্ধারিত ফরমে নির্ধারিত ফিসহ পুনঃনিবন্ধনের আবেদন করতে হবে।

কোনো নির্দিষ্ট খাতে কপিরাইট সমিতি গঠিত না হলে বা কোনো সমিতির কার্যক্রম স্থগিত থাকলে সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে কপিরাইট সমিতির কার্যক্রম কপিরাইট অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হইবে।

কপিরাইট আইনের অংশীজন ও বাংলাদেশের একমাত্র কালেকটিভ ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশন (সিএমও) বিএলসিপিএস-এর প্রধান নির্বাহী সুজিত মোস্তফা বলেন, “এই আইনটি সংশোধনের পর আইনটি সঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে পাইরেসির হার কমতে শুরু করবে। তখন আমরাও রয়্যালিটি মানির জন্য লড়াই করতে পারব।”