বঙ্গবন্ধুকে স্মরণে রেখে এক হয়ে দেশ গড়ার আহ্বান

জাতির জনককে হারানোর দিনটি স্মরণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2017, 03:01 PM
Updated : 14 August 2017, 03:05 PM

৪২ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ছয় বছরের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন ঘাতকের গুলি থেকে রেহাই পায়নি।

১৫ অগাস্ট তাই জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। মঙ্গলবার সরকারি ছুটির এই দিনে জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত, থাকবে নানা কর্মসূচি।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে সকাল সাড়ে ৬টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন।

সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী গোরস্থানে ফুল দেবেন শেখ হাসিনা, ১৫ অগাস্ট নিহত তার অন্য সব স্বজনদের কবর সেখানে।

ঢাকায় কর্মসূচির পর সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অফ অনার প্রদান এবং মোনাজাত হবে।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দুপুরে বঙ্গভবনের দোয়া মাহফিলে রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকবেন।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার উপস্থিতিতে সকালে সুপ্রিম কোর্টে আলোচনা হবে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে দিনটিতে।

১৫ অগাস্টের ঘটনার নেপথ্য কারণ ব্যাখ্যা করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেন, “এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মুছে ফেলে পরাজিত শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।”

রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন। আসুন, তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আত্মনিয়োগ করি।”

স্বজন হারানোর এই দিনে শোককে শক্তিতে পরিণত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

জনকের প্রতি শ্রদ্ধা (ফাইল ছবি)

বাণীতে তিনি বলেছেন, “আসুন, তার ত্যাগ এবং তিতীক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ ধারণ করে সবাই মিলে একটি অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। প্রতিষ্ঠা করি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।”

প্রধানমন্ত্রী জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন।

স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং উন্নয়ন ও গণতন্ত্র-বিরোধীদের যে কোনো ‘অপতৎপরতা’ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে সবাইকে প্রস্তুত থাকতেও বলেন শেখ হাসিনা।

৪২ বছর আগে বঙ্গবন্ধু ভবনে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।

সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।

ধানমণ্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু ভবনের অদূরে নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

১৫ অগাস্ট  মিলাদ ও দোয়া হবে দেশের সব মসজিদে। মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জাসহ সব উপসনালয়ে হবে বিশেষ প্রার্থনা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হবে।

বিকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বাদ আছর মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে মহিলা আওয়ামী লীগ।

শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠান।

স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।

এরপর বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ছেষট্টির ছয় দফা প্রণয়নে ভূমিকা রেখে এবং ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হিসেবে শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।

তার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামেই অভ্যূদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।

১৯৭৫-এর পর ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পালিত হয়ে আসছে ১৫ অগাস্ট। ’৭৫ এর পর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দিনটি পালিত হয়নি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ১৫ অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গেলে জাতীয় শোক দিবস বাতিল করে দেয়।

পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হাই কোর্টের রায়ে ২০০৮ সাল থেকে দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাসের নৃশংসতম এই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনিদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচার শুরু হয়। তবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার গতি শ্লথ হয়ে যায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে শেষ করার পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে দণ্ডিত ছয় খুনি এখনও বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন।