বৃষ্টিতে জলজট, নাকাল নগরবাসী

টানা নয় ঘণ্টার বর্ষণে রাজধানীর রাজপথে জলজটের সঙ্গে যানজটে চরম ভোগান্তির একটি দিন পার করতে হয়েছে রাজধানীবাসীকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2017, 07:44 AM
Updated : 26 July 2017, 02:13 PM

বুধবার সকালে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়েই কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানির সামনে পড়তে হয় দেড় কোটি মানুষের এ শহরের বাসিন্দাদের।  

এরপর দুপুর পর্যন্ত টানা বৃষ্টির মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের ধাপে ধাপে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

লঘুচাপের প্রভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে গত রোববার থেকেই বর্ষণ চলছিল। এর মধ্যে মঙ্গল রাত ৩টার দিকে ঢাকায় শুরু হয় টানা বৃষ্টি। বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকায় ৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যাওয়ায় যানবাহনের গতি কমে সৃষ্টি হয় জট। বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন কাজের জন্য বেহাল রাস্তায় সেই জট আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। 

এর মধ্যে গণপরিবহন কম থাকায় রাস্তায় নামা মানুষকে গাড়ি পেতে নাকাল হতে হয়। অটোরিকশায় গুণতে হয় কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। তারপরও যানজটের কারণে প্রায় কেউই সকালে সময়মত কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেননি।

পরিস্থিতি দেখার জন্য ধানমণ্ডি এলাকায় গিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকনকেও হাঁটু পানিতে নামতে হয়। জলাবদ্ধতার জন্য একটানা বৃষ্টিকে দায়ী করে শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।  

আর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকার এ পরিস্থিতিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে বর্ণনা করে প্রতিশ্রুতি দেন, সামনের বছর আর এমন পরিস্থিতি হবে না।

ভোগান্তি নগরজুড়ে

মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে অনীক সকালে পান্থপথের বাসা থেকে অফিসে পৌঁছান সোয়া দুই ঘণ্টায়, যে পথে তার আধা ঘণ্টাও লাগার কথা না।

তিনি জানান, ভারি বৃষ্টির কারণে রাস্তায় যানবাহন ছিল অন্য দিনের তুলনায় কম। ফলে গাড়ি পেতেই সবার সমস্যা হয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জলাবন্ধতার কারণে যানজটে আটকে থাকতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। 

“ফার্মগেইট বাসস্ট্যান্ড থেকে বিজয় সরণির মোড় পর্যন্ত এক কিলোমিটার যেতেই আমার লেগেছে ৫৫ মিনিট। মনিপুরী পাড়ার এক নম্বর গেইট থেকে বিজয় সরণি মোড় পেরিয়ে পুরো রাস্তায় পানি জমে আছে।”

দক্ষিণ বনশ্রী থেকে এনজিও কর্মী মোস্তাফিজুর রহমানের সকালে গুলশান এক নম্বরে যেতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। প্রগতী সরণিতে পানি জমে থাকায় ওই সড়কে দীর্ঘ যানজটের কথা জানান তিনি।

বিমানবন্দর সড়কে বনানীগামী রাস্তা যানজটে একপ্রকার অচল হয়ে থাকতে দেখা যায় বেলা ১০টার পর। শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী ওঠানামার জন্য বাসগুলো এলোমেলোভাবে থামানোয় খিলক্ষেত থেকে শেওড়া পর্যন্ত যানজট ছড়িয়ে পড়ে।

খিলক্ষেতের প্রধান রাস্তা গত দেড় মাস ধরেই জলমগ্ন। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত থেকে ভারি বৃষ্টিতে খিলক্ষেতে বাজার থেকে বটতলা পর্যন্ত রাস্তায় কোমর পানি জমে গেছে।

অবস্থা এতটাই খারাপ যে দুপুর পর্যন্ত ওই সড়কে রিকশা চলাচলও বন্ধ ছিল বলে ‌‌হাজীবাড়ি রোডের বাসিন্দা তুষার জানান।

উন্নয়ন কাজ চলায় যমুনা ফিউচার পার্কের পর থেকে প্রগাতী সরণির প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় যানজট থাকায় তার চাপ পড়ে সড়কের অন্যান্য অংশেও। খিলক্ষেত ফ্লাইওভার থেকেই থেমে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায় দুপুরের আগে। 

মেরুল বাড্ডা থেকে পল্টন মোড়ে আসতে অন্য সময় ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা লাগলেও বুধবার দুই থেকে তিন ঘণ্টা লেগেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান।

রামপুরা ব্রিজের পর থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত প্রায় পুরো সড়কে বড় বড় গর্তে পানি জমে থাকায় সেই পথে যাত্রা হয়ে উঠেছে এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা।

হিমেল হক নামে রামপুরার এক বাসিন্দা বলেন, “বিপদ হয়েছে অফিসযাত্রীদের। রাস্তায় গাড়ি থমকে আছে। তার ওপর রাস্তা জুড়ে উন্নয়নের বিড়ম্বনা। কাদা পানি মাড়িয়ে সড়কে চলতে হচ্ছে।”

ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য মালিবাগের পুরো এলাকাতেই নাজুক পরিস্থিতি। এর মধ্যে কোথাও কোথাও হাঁটু পানি জমে থাকতেও দেখা যায়। শান্তিনগরের অবস্থাও একই রকম।

গুলিস্তানের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, মেরুল বাড্ডা থেকে পল্টনে যাওয়ার জন্য সকাল ৮টা থেকে পৌনে ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনো বাসে উঠতে পারেননি তিনি।

আর শরিফুল আলম নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, অটোরিকশায় ৪০০ টাকা ভাড়া চাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অনেক বলে কয়ে এক রিকশাওয়ালাকে রাজি করিয়ে দুই ঘণ্টায় পল্টনে অফিসে গিয়েছেন তিনি। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এমনিতেই রাস্তার যে অবস্থা, এর মধ্যে বৃষ্টি হলে তো ঢাকা শহর সমুদ্র হয়ে যায়। এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা আছে বলে আমার মনে হয় না।”

নয়া পল্টন আর কারওয়ান বাজারের মত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সড়কে পানি জমে যাওয়ায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের সব এলাকায়।  

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সামনের সড়কে, অর্থাৎ ওসমানী স্মৃতি মিলনায়নের পাশের রাস্তায়ও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। সচিবালয়ের ভেতরে জমে যাওয়া পা‌নি সরাতে ডাকা হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনিন্দিতা সাহা সোমা জানান, মিরপুর সড়কে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে প্রায় সারাদিন কোমর পানি ছিল। শুক্রাবাদ থেকে রাপা প্লাজা পর্যন্ত পুরো এলাকাতেই ছিল জলাবদ্ধতা। ক্লাসে যাওয়ার জন্য বের হয়েও এই পরিস্থিতির কারণে তাকে বাসায় ফিরে যেতে হয়।

গ্রিনরোডের বাসিন্দা আইনজীবী আসিফ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসার সামনের রাস্তার হাঁটু পানি ভেঙে অনেক কষ্টে সিএনজি জোগাড় করতে হয়েছে। এরপর মতিঝিল আসার পথে যে ভোগান্তি, তা অবর্ণনীয়।”

ইস্কাটন, পান্থপথ, রাজাবাজার ও রায়ের বাজারে ভেতরের প্রায় সব গলিতেই পানি জমে থাকতে দেখা যায় সকালে। কোথাও কোথাও পানি ঢুকেছে বাড়ির নিচতলাতেও।  

সাতরাস্তা এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহবুবা সুলতানা জানান, ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে অফিস পর্যন্ত যাওয়ার পথে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখেছেন তিনি।
 

“বাসার গলি থেকে শুরু করে পূর্ব রাজাবাজার, ফার্মগেইট, তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন সড়কে পানি। তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকার এক গলিতে আর বিজি প্রেসের সামনে হাঁটু পর্যন্ত পানি পার হয়ে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে।”

পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার এক বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চারপাশের সব সড়কেই পানি। অনেকগুলো বাড়িতেও পানি ঢুকেছে। পুরো মৌসুমে এবার এভাবে পানি জমছে। এখন আমাদের বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে তো পানি নামবে না।”

পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার রাজারদেউরি এলাকায় সকালে ছিল কোমর পানি। আর জজ আদালতের সামনে হাঁটু পানি। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে এদিন আদালতে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের উপস্থিতিও ছিল কম।

ওয়াসার সংস্কার ও মেট্রোরেলের প্রস্তুতির কাজে রাস্তা খোঁড়াখুড়িতে মিরপুরবাসী এমনিতেই ভোগান্তিতে ছিল। বৃষ্টির জলজটে সেই ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়েছে বুধবার।

মিরপুর ১২ নম্বরের ই-ব্লক, কালশী রোড, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া, আগারগাঁও ও তালতলার বিভিন্ন রাস্তা পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা যায় দুপুর পর্যন্ত।

এক সিএ ফার্মের কর্মকর্তা রাশেখ-উর-রহমান জানান, মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর থেকে সকালে তার ধানমণ্ডি যেতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা।

তিনি বলেন, “রাস্তার অর্ধেক তো খুঁড়ে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। আর আমাদের ড্রেনেজ সিস্টেম তো ভালো না, পানি যাবে কেমন করে? ম্যানহোলগুলোতে ময়লা আটকে থাকে, এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করলে তো এমন হত না।”

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বৃষ্টিতে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কাজীপাড়া পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে জলাবদ্ধতা এখন নিত্যচিত্রে পরিণত হয়েছে।

কাজীপাড়ার আসবাবপত্রের দোকান ‘লং লাইফ ফার্নিচার’ এর মালিক মোহাম্মদ কাদের বলেন, “এমন কোনো সময় নাই যে এখানে পানি জমে না। নোংরা পানি পার হয়ে দোকানে আসতে হয়। আমরা নিজেরা লোক দিয়ে ম্যানহোল খুলে দেই। তখন কিছুটা পানি কমে। এভাবে পানি জমে থাকলে কাস্টমার আসবে কীভাবে?”

রাস্তায় বাস কম থাকার কারণ জানতে চাইলে ‘সময় নিয়ন্ত্রণ’ পরিবহনের চালক গোলাম কুদ্দুস বলেন, রাস্তায় পানির কারণে ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার ভয়ে অনেক মালিক গাড়ি বের করতে নিষেধ করেছেন।

“তাছাড়া বাইর হইয়া তো লাভ নাই। কদমতলী থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় রওনা দিয়া পূরবীতে আসছি ২টায়। জ্যামে বইসাই সময় যায়। দুপুর পর্যন্ত হইছে একটা ট্রিপ। আইজকা আর গাড়ি চালামু না।”

এমনিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতা খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু ভারি বৃষ্টির কারণে বুধবার রেজিস্ট্রার ভবনের গেইট, উপাচার্য কর্যালয়ের সামনে রাস্তা, মলচত্বর, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুই পাশে, কলা ভবনে প্রক্টর অফিস ও ডিন অফিসের গেইটের সামনেও পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) এ কে এম আফজালুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ক্যাম্পাসের ভেতরে ওয়াসার যে লাইন আছে, সমস্যা সেখানে। ক্যাম্পাসের লাইনগুলো দিয়ে পানি ওয়াসার লাইনে দ্রুত নামতে পারে না বলে জলাবদ্ধতা হয়।”

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য ও ছবি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রকাশরঞ্জন বিশ্বাস, নুরুল ইসলাম হাসিব, শহীদুল ইসলাম, কামাল  তালুকদার, ওবায়দুর মাসুম, মাসুম বিল্লাহ, জয়ন্ত সাহা, কাজী নাফিয়া রহমান, তপন কান্তি রায়]