বাড়ি ভাঙছে গায়ের জোরে: মওদুদ

আইনি লড়াইয়ে হেরে দীর্ঘ চার দশক ধরে দখলে রাখা বাড়ি হারানোর পর গুলশানের সেই বাসা ভাঙায় শুরু রাউজকের অভিযানকে বেআইনি বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2017, 06:12 AM
Updated : 25 June 2017, 02:11 PM

বিএনপির এই নেতাকে বাড়িটি থেকে উৎখাতের ১৮ দিনের মাথায় রোববার সকালে সেটি ভাঙা শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক।

ভাঙার কাজ শুরুর দুই ঘণ্টা পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মওদুদ বলেন, “এটা ভাঙা সম্পূর্ণ বেআইনি।

“আদালতের কোনো নির্দেশ নাই এবং কোনো নোটিসও নাই। যা করছে, সবই তারা গায়ের জোরে করছে। আইনের চাইতে এখন শক্তি বেশি কার্য্কর।”

গুলশান এভিনিউয়ের ১৫৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ওই বাড়িতে মওদুদ বসবাস করে আসছিলেন গত চার দশক ধরে। রাজউকের হিসাবে ওই সম্পত্তির দাম তিনশ কোটি টাকার বেশি।

ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাইয়ের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে দুদক মামলা করলে চার বছর আগে শুরু হয় আইনি লড়াই। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় মওদুদের বিপক্ষে গেলে গত ৭ জুন ওই বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করে রাজউক।

আইনি লড়াইয়ে হেরে গেলেও আদালতের বা রাজউকের পক্ষ থেকে তাকে কোনো রকম নোটিস ছাড়া উচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপি নেতা মওদুদ। নিজের দখলি স্বত্বে বিঘ্ন না করার জন্য সরকার ও রাউজকের বিরুদ্ধে একটি দেওয়ানি মামলা করেছেন বলেও উচ্ছেদের দিন সাংবাদিকদের জানান তিনি।

এদিন রাউজকের ভাঙার অভিযানের সময় বাড়িটির বিষয়ে আদালতে দুটি মামলা রয়েছে বলে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ।

তিনি বলেন, “একটা রিট পিটিশন হাই কোর্টে বিচারাধীন আছে, যেটা ২ জুলাই শুনানি হওয়ার কথা। আরেকটা টাইটেল স্যুট ফাইল করেছি নিচের কোর্টে, সেটাও পেন্ডিং আছে শুনানির জন্যে।

“আমি মনে করি আদালতের বিচারাধীন অবস্থায় এ ধরনের অভিযান সম্পূর্ণভাবে আদালতের প্রতি চরম অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

গুলশান এভিনিউয়ের ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে তিনি ওই বাড়ির মালিকানা পান।

১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। ওই বছরই মওদুদ বাড়িটির দখল নেন।

কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে ভাইয়ের নামে দখল করা ওই বাড়িতে ভাড়াটিয়া ছিলেন বলে দুদকের মামলার পর থেকে বলতে শুরু করেন ব্যারিস্টার রাজনীতিবিদ মওদুদ।

বাড়িটি ভাঙার সময় রোববার দুপুরে বাড়িটির ঠিক পেছনে গুলশানের ৫১ নম্বর রোডে নিজের ফ্ল্যাটে সাংবাদিকদের সামনে এসে ভাড়াটিয়া হিসাবে অধিকার নিশ্চিত করতে নিম্ন আদালতে মামলা দায়ের করার জানান মওদুদ।

তিনি বলেন, “নিচের আদালতে আমি একটা স্যুট ফাইল করেছি। সরকার ও রাজউক আমাকে কোনোভাবে, আমার যে ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকার অধিকার, তা ক্ষুন্ন না করে। সেটাও সমন জারি হয়েছে। সাত তারিখে শুনানি হয়েছে। তাদের ওপর সমন জারি হয়েছে।

“এই দুটো মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় রাজউক যে কাজটা করল, যেকোনো বিবেকবান মানুষ হিসাবে এটা গর্হিত অপরাধ হিসাবে মনে করবেন।”

এরশাদ সরকারে উপ-রাষ্ট্রপতির পদ নেওয়া মওদুদ বাড়ি ভাঙাকে আদালত অবমাননার সামিল দাবি করে একে মানবতাবিরোধী বলেও মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, “যেখানে বিষয়গুলো বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও এভাবে বলপ্রয়োগ করে, অস্ত্রের মাধ্যমে এবং জোর করে বাড়ি দখল করা এবং বাড়ি আজকে ভেঙে ফেলার যে অভিযান করছে, দুটোই মানবতা বিরোধী, মানব অধিকার বিরোধী, সংবিধান বিরোধী, আইনের বিরোধী।

“আদালতের নির্দেশ ছাড়া, কোনো নোটিশ ছাড়া কাউকেই উৎখাত করার কোনো আইন বাংলাদেশের মাটিতে নাই। কিন্তু তাদের কাছে এই আইন তুচ্ছ। এটাই প্রমাণ করে, এই সরকার আইনের প্রতি, আদালতের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখায় না।”

নিজেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য হিসেবে তুলে ধরে সেই কারণেই রোজার শেষ দিকে এসে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিভিন্ন দল ঘুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে থাকা মওদুদ।

“আমি সরকারের বাইরে বিরোধীদলের নেতৃস্থানীয় একজন সদস্য। এটাই তাদের আক্রোশ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরম বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাল। আজকে রামজান শেষ দিন, ছুটির দিন। কিন্তু এই সকালে সমস্ত .. রাজউক গুলশানের বাড়িটি ভাঙার কাজ করছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনের পরিপন্থি।”

চার দশক দখলে রাখা বাড়ি হারানোর পর থেকে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে আসা মওদুদ এদিন গুলশানের ফ্ল্যাটে সাংবাদিকদের কাছে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন।

তিনি বলেন, “আদালতের কোনো নির্দেশ নাই। যদি তারা কোনো নির্দেশ দেখাতে পারে, তাহলে আপনাদের তা দেখানো উচিত। আইনের বিধান আছে যে, যে দখলে আছে.. সে আইনত থাকুক বা বেআইনিভাবে থাকুক, তাকে ৩০ দিনের নোটিশ দিতে হবে। এটা আমাদের আইনর একটা ম্যান্ডেটরি পজিশন। সে ধরনের কোনো নোটিশ দেওয়া হয় নাই।

“তারা তো আদালতে বলবে যে, আমরা (সরকার) দখল নিয়ে নিয়েছি। দেখা যাক, এখানে তো কিছু বলতে পারব না।”

‘হেরিটেজ বাটিটি ওই বাড়িতে আছে নিশ্চয়ই’

৫১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি বাড়িটি ভাঙার অভিযান সাংবাদিকদের দেখাতে দেখাতে ৪৩টি জিনিসপত্রের একটি তালিকা তুলে ধরে সেগুলো ভাঙার সময়ও ভেতরে ছিল বলে দাবি করেন কবি জসিমউদ্দিনের জামাতা মওদুদ।

তিনি বলেন, “আমাদের অনেকগুলো মাল, অনেকগুলো জিনিষপত্র পড়ে আছে। এখনো ওই বিল্ডিংয়ে আছে। এটা আমরা আদালতে সাপ্লিমেন্টারি এফিডেফিট করে রেখেছি।”

“এখানে (তালিকায়) ৪৪টি আইটেম আছে। আমরা এয়ারকন্ডিশনের খোলস পেয়েছি, কম্প্রেসার পাইনি। আপনার এখনো দেখবেন, ছাদের ওপর ছাদের বাইরে কম্প্রেসারগুলো লাগানো আছে। এগুলো তো আমাদের সম্পদ। এগুলো তো রাজউকের সম্পদ না।”

এরপর তালিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণগুলোর কয়েকটি তুলে ধরেন এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, “যেগুলো ইমপর্টেন্ট সেগুলো বলছি। আমাদের চারটা ঝাড় বাতি ছিল। তারমধ্যে, দুটো ছিল একশত বছরের পুরনো। সেই ঝাড় বাতিগুলোর চিহ্ন আমরা দেখি নাই। সেগুলো নিশ্চয়ই ওই বাড়িতেই আছে।”

মওদুদ বলে চলেন, “আমার সবচাইতে .. যে বুক সেলফ্ যে লাইব্রেরি.. আমি এটা দাবি করি যে, বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিবিদরে এত বড় প্রাইভেট কালেকশন নাই। এখানে অনেক বিরল পুস্তক রয়েছে। অনেক কষ্ট করে ৫০/৬০ বছর যাবৎ আমি এগুলো সংগ্রহ করেছি। এগুলোর সঙ্গে আমার আত্মা জড়িত। কিন্তু আজকে এই বইগুলো ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আছে। অনেক বই পেয়েছি। কিন্তু অনেক মূল্যবান বই পাই নাই।

“আমার একটা হেরিটেজ.. একটা বাটি ছিল- মাটির বাটি। ইজিপসিয়ান সয়েলের, এক হাজার বছরের…। সে জিনিসটা যে কোথায় গেছে.. সেটা অনেক খুঁজেছি, পাইনি। ওটা নিশ্চয়ই ওই বাড়িতে আছে।”

অনেক মূল্যবাদ চিত্রকর্ম খুঁজে পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন এই রাজনীতিবিদ।

“বিভিন্ন নাম করা চিত্রশিল্পীর দুর্লভ পেইন্টিংস। ওখানে কামরুল হাসানের নামকরা পেইন্টিংগুলো আছে.. নাম করা শিল্পীদের। সেগুলো আমরা পাইনি। ওগুলো ওখানেই আছে। এরকম অনেক কিছু। ৪৩টি।”

মওদুদ আরও বলেন, “আমরা আর আমার স্ত্রীর বইয়ের হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি আছে.. এটা খুবই মূল্যবান। এই পাণ্ডুলিপিগুলোর একটাও পাইনি। এগুলো তো অমূল্য সম্পদ।”