বাড়ি মওদুদকে ছাড়তেই হল

বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ চার দশক ধরে গুলশানের যে বাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর অভিযান চালিয়ে সেই বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2017, 08:47 AM
Updated : 7 June 2017, 04:39 PM

রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার অলিউর রহমানের নেতৃত্বে বুধবার বেলা ১২টার দিকে গুলশান এভিনিউয়ের ১৫৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ওই বাড়িতে অভিযান শুরু হয়।

এরপর রাজউকের একটি ট্রাক ও তিনটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই বাড়ির মালপত্র মওদুদ ও তার এক আত্মীয়র মালিকানাধীন অন্য দুটি বাড়িতে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলে।

ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় ৩০০ কোটি টাকার ওই সম্পত্তিতে উচ্ছেদ অভিযান ঘিরে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব সেখানে ছিল; ছিল জলকামান, প্রিজনভ্যান, সাঁজোয়া যান ও রাজউকের বুলডোজার।

অলিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “এটা রাজউকের সম্পত্তি। দীর্ঘদিন ধরে তারা দখল করে রেখেছিলেন। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। আমরা দখলমুক্ত করছি।”

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ ওই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা রাজনীতি করি বলে, বিরোধী দল করি বলেই কি আজকে এই অবস্থা? সরকারি দলের কেউ হলে আজকে এরকম হত? আজকে বিরোধী দল করি বলেই প্রতিহিংসার এই চরম দৃষ্টান্ত।”

বাড়ির কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মওদুদের স্ত্রী ও মেয়ে আছেন দেশের বাইরে। কেয়ারটেকার ও অন্যরা মিলেই জিনিসপত্র গাড়িতে তোলার জন্য কিছুটা গুছিয়ে দেন। 

একটি পিয়ানো, কাঠের একটি বড় সিন্দুক, অর্ধশতাধিক স্যুটকেস, কয়েক ডজন সোফা ও চেয়ার, বেশ কয়েকটি আলমারি, খাটসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিযন্ত্রণ যন্ত্রসহ গৃহস্থালীর যাবতীয় সামগ্রী ট্রাক ও পিকআপে করে দফায় দফায় সরিয়ে নিতে দেখা যায়। 

মওদুদের জুনিয়র ব্যারিস্টার এহসানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আপাতত মালপত্রগুলো দুটো ফ্ল্যাটে রাখা হচ্ছে।

“গুলশানের ৮৪ নম্বর রোডে একটি ফ্ল্যাট আছে, ওটা স্যারের নিজের ফ্ল্যাট। কিছু মালামাল ওখানে যাবে। আর কিছু যাবে ৫১ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাটে…। সেটা স্যারের এক আত্মীয়র বাসা।”

আইনি লড়াই

রাজউকের এক কর্মকর্তা জানান, এক বিঘা ১৩ কাঠা ১৪ ছটাক জমির ওপর ওই বাড়ি। গুলশানের ওই এলাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম মোটামুটি ১০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে পুরো সম্পত্তির দাম তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ কোটি টাকায় পৌঁছায়।  

ওপর ওই বাড়ির প্রকৃত মালিক ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে তিনি ওই বাড়ির মালিকানা পান।

১৯৬৫ সালে বাড়ির মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এহসান স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা আর ফিরে না আসায় ১৯৭২ সালে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়।

ওই বছরই মওদুদ ওই বাড়ির দখল নেন। কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ‘ভুয়া’ আমমোক্তারনামা তৈরি করে মওদুদের ভাই মনজুর আহমদের নামে ওই বাড়ির দখল নেওয়া হয়েছে অভিযোগ এনে দুদক মামলা করলে চার বছর আগে শুরু হয় আইনি লড়াই। 

মওদুদ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেও রায় তার বিপক্ষে যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও গত রোববার তা খারিজ হয়ে যায়। ফলে মওদুদের বাড়ি ছাড়া অনিবার্য হয়ে পড়ে।

রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেছিলেন, “দেশে কি আইন নাই? আমি আইনের আশ্রয় নেব। আদালতের আশ্রয় নেব। বাড়ি ছাড়ব না।”      

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “মামলায় হেরে গিয়ে এ কথা বলাও দুঃখজনক। অবশ্যই বাড়ি ছাড়তে হবে।”

অভিযান

রায়ের দুই দিনের মাথায় বুধবার দুপুরের দিকে ওই বাড়ির দখল বুঝে নিতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। বিচ্ছিন্ন করা হয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ।

পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মোস্তাক আহমেদ, গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক, পরিদর্শক (তদন্ত) সালাউদ্দিন মিয়াসহ উর্ধ্বতন কর্মকতাদেরও ঘটনাস্থলে দেখা যায়।

অভিযান শুরুর কিছু সময় পর আইনজীবীর পোশাকে ওই বাড়ির সামনে হাজির হন ব্যারিস্টার মওদুদ। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুরোধে গেট থেকে সরে রাস্তার পাশে দাঁড়ান তিনি।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আইনমন্ত্রী মওদুদ বলেন, “সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা ছিল সেটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে… কোনো আইন নেই? যে এত দিনের মধ্যে আপনাকে বাড়ি ছাড়তে হবে?... আজকে আদালতের কোনো অর্ডার আছে? তাদের (রাজউক) কোনো অর্ডার আছে? একটা বাড়িতে ঢুকে গেল! আমাদের দেশে কি আইন নেই?”

রাজউক কোনো নোটিস ছাড়াই এ অভিযান চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অলিউর রহমান বলেন, “এটা তো আমাদের সম্পত্তি। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। এটা কি উনার সম্পত্তি? নোটিস দেব কেন?”

রাজউকের এই কর্মকর্তা বলেন, মওদুদ আহমদ এ বাড়ি দখলে রেখেছিলেন ‘অবৈধভাবে’। এখন রাজউক বিধি অনুযায়ী তার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে।

“আপতত এটা তালাবদ্ধ থাকবে, পরে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। উনার মালামাল তিনি যেখানে চেয়েছেন, সেখানে পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।”

‘এদেরকেও জনগণ বিদায় করে দেবে’

সন্ধ্যায় ওই বাড়ির সামনে মওদুদ আহমদকে দেখতে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যাকে একইভাবে আইনি লড়াইয়ে হারের পর সাত বছর আগে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল।

তখন সাংবাদিকদের সামনে কোনো কথা না বললেও তার কিছুক্ষণ আগে এক ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “এদের (ক্ষমতাসীন) যারা বাড়ি-ঘর দখল করেছে, ইয়ে করেছে, জনগণ তো এদেরকে দেখবেন, জনগণ সব হিসাব রাখছে, এদেরকেও ওই এক কাপড়ে বাড়ি-ঘর থেকে সবাইকে বিদায় করে দেবে। এরা মনে করে যে এরা খুব ভালোভাবে থাকবে। জনগণ এটা হতে দেবে না।”

তার আগে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু ওই বাড়ির সামনে যান।

চলে যাওয়ার আগে মোশাররফ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আইনি বিষয় জানি না। আমরা জানি উনি ছিলেন। এখন দেখছি তাকে বের করে দেওয়া হচ্ছে।”

‘সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে’

কবি জসীমউদ্দীনের জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপক্ষ সমর্থন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল করা হয়।

অবশ্য পরে দেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগ দেন মওদুদ। জিয়া তাকে মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর মওদুদ সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাত ধরেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে তিনি মন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন।

১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মওদুদ বিএনপিতে ফেরেন এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। উচ্ছেদ অভিযান চলার সময় বাড়ির সামনে বিমর্ষ হয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

দুপুরে অভিযানের চলাকালে ঘটনাস্থলে আসার পর মওদুদ সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধী দলের রাজনীতি করার কারণেই তাকে ‘এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে’।

“আমি কী করব- কী করার আছে? রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকব…কী করার আছে! জোরের বিরুদ্ধে, বেআইনি শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের মত নাগরিকদের করার আর কী থাকে?”

সন্ধ্যা পর্যন্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে মালামাল গাড়িতে ওঠানো দেখেন এই বিএনপি নেতা। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আবারও তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।

“সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। আমার দীর্ঘদিনের সংগ্রহ, হাজার হাজার বই এসব কোথায় নেব?”

কথা বলার এক পর্যায়ে কয়েক কদম হেঁটে ফুটপাতে রাখা একটি সোফায় বসে পড়েন ক্লান্ত মওদুদ। উচ্ছেদ অভিযান না চালানোর বিষয়ে মঙ্গলবার জজ আদালতে করা এক মামলায় রাজউকের বিরুদ্ধে সমন জারির প্রসঙ্গ টানেন তিনি।

মওদুদ বলেন, “১৯ জুলাই সমন জারি করা হয়েছে। এ সময়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর কথা না। কিন্তু তারা বিনা নোটিসে বেআইনিভাবে সেটা করেছে। সরকারের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রতিহিংসার কারণে এমন করা হচ্ছে। তারাতো আইনের তোয়াক্কা করছে না।”  

জুনিয়র কয়েকজন আইনজীবীর পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মীকেও বাড়ির সামনে এসে মওদুদের খোঁজ খবর নিয়ে যেতে দেখা যায়।