‘রথযাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে’

রথযাত্রায় মাইকের ব্যবহার ও প্রসাদ বিতরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চলছে বলে তাতে বিভ্রান্ত না হতে আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2017, 11:38 AM
Updated : 24 June 2017, 12:34 PM

শনিবার দুপুরে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে রথযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি জয়ন্ত সেন এবিষয়ে সতর্ক করেন।

তিনি বলেন, “প্রশাসনের তরফ থেকে কীর্তনের সময় মাইক ব্যবহার ও প্রসাদ বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়নি।… কে বা কারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফেইসবুকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

“আমরা বলতে চাই, এই অপপ্রচার কোনো শুভলক্ষণ নয়। তারা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ‘মরালিটি’ ভাঙার চেষ্টা করছে।”

লিখিত বক্তব্যে পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পাল জানান, গত সোমবার রথযাত্রায় আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে সভা নিয়ে অনলাইন পোর্টাল ও ফেইসবুকে প্রচারিত সংবাদ ‘জনমতে বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি করেছে।

তিনি বলেন,  “এই ব্যাপারে আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, এই সভা থেকে মাইক ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। শুধুমাত্র জনস্বার্থে ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে শোভাযাত্রার সময় পিএ সেট (সাউন্ড সিস্টেম) ব্যবহার না করার অনুরোধ করা হয়।”

তবে ওই সভার পর পুলিশের পাঠানো এক বিবৃতিতে ‘রথযাত্রা পথে মাইক ব্যবহার না করা’ এবং ‘রথ থেকে ফল ও খাদ্য ছুঁড়ে না ফেলার’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।

সারা দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা, প্রতিমা ভাংচুর, জমি দখলের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলে অভিযোগ করেন পূজা উদযাপনের পরিষদের নেতারা।

তাপস বলেন, “সাম্প্রদায়িক শক্তি এমন সব বিবৃতি ও বক্তব্য দিচ্ছে যা ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা বিকাশে সহায়তা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হতে যাচ্ছে রথযাত্রা উৎসব।

“স্বাভাবিকভাবে ভক্তদের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ ব্যাপার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এই রথযাত্রায় রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার কথা উল্লেখ আছে। তবে উড়িষ্যার পুরীধামে অনুষ্ঠেয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রাই প্রচলিত।

জগতের নাথ বা অধীশ্বর যিনি তিনি-ই জগন্নাথ।শাস্ত্রে আছে, রথোপরি বামন বা জগন্নাথকে দেখতে পেলে জীবের আর পুনর্জন্ম হয় না। আর তাই জগন্নাথদেবকে রথে চড়িয়ে মুক্তিকামী মানুষ তার কৃপা প্রার্থনা করে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রধান কেন্দ্র উড়িষ্যার সমুদ্রতীরবর্তী পুরীধাম। তার অনুসরণেই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে থাকে।

বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা শুরু করে একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা উল্টা রথ। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই এনে রাখা হয়।

সেই হিসেবে রোববার রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। ৩ জুলাই উল্টো রথযাত্রার মাধ্যমে সমাপ্তি হবে এই উৎসবের। রথযাত্রার এক বা দুই দিন পর মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর।

সংবাদ সম্মেলনে তাপস কুমার পাল ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী রথযাত্রার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় রথযাত্রাটি রোববার দুপুর ২টায় স্বামীবাগের ইসকন মন্দির থেকে বের হয়ে জয়কালী মন্দির, ইত্তেফাক, শাপলা চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, পল্টন, প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর ও পলাশী ঘুরে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এসে শেষ হবে।৩ জুলাই উল্টোরথে একইপথে ইসকন মন্দিরে ফিরে যাবেন জগন্নাথদেব।

রথযাত্রার আগে দুপুর ১২টায় ইসকনে এক আলোচনা সভায় থাকবেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

পরে রথযাত্রার উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, “এবারের রথযাত্রায় বড় কোনো সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হবে না। আমরা কীর্তনের সময় যথারীতি মাইক ব্যবহার করব। ভক্তদের উদ্দেশ্যে এবার আর প্রসাদ ছুঁড়ে মারা হবে না, তাদের হাতে প্রসাদ দেওয়া হবে।

“আগেই বলে দেওয়া হয়েছে, কেউ কোনো ব্যাগ নিয়ে আসতে পারবেন না। আর কেউ পথিমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রথযাত্রায় যোগ দিতে পারবেন না।”

তাপস কুমার পাল জানান, ডিএমপির পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়েছে, রথযাত্রায় পথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় একহাজার ৩০০ পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পুলিশের সঙ্গে ইসকনের ৪০০ স্বেচ্ছাসেবক মাঠে নিয়োজিত থাকবেন।

এবার রথযাত্রার প্রবেশস্থল ও আশপাশে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হবে, রথযাত্রা পথের দুপাশের ভবনগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হবে, স্থাপন করা হবে সিসিটিভি ক্যামেরা। রথযাত্রায় হকার প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।মোটরসাইকেলসহ সন্দেহভাজন যানবাহন তল্লাশি করা হবে।

এবার ঢাকার পাশাপাশি রথযাত্রা উদযাপিত হবে মানিকগঞ্জের ধামরাই, সিলেট, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, রাজশাহীর পুটিয়া, ফরিদপুরের ওড়াকান্দি, বাগেরহাটের ফকিরহাটে। এছাড়াও ঢাকায় তাঁতীবাজারের জগন্নাথ জিও ঠাকুর মন্দির ও ওয়ারীর রামসীতা মন্দির থেকে রথ বের হবে, তবে তা মূল রথযাত্রার সঙ্গে এসে মিশবে না।

তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রথযাত্রাটি হয় মানিকগঞ্জের ধামরাইয়ের যশোমাধবের মন্দিরে। উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে সাটুরিয়া বালিয়াটির জমিদাররা এই মন্দিরে ৬০ ফুট উঁচু রথ নির্মাণ করেছিলেন।ত্রিতলবিশিষ্ট ওই রথটি টানতে ২৭ মন শনের দড়ি ব্যবহৃত হতো। রথযাত্রা উপলক্ষে সেখানে মাসব্যাপী মেলা হতো। সমগ্র দেশ, এমনকি ভারত-নেপাল থেকেও ভক্তদের সমাগম হতো রথের দড়ি টানার জন্য।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ওই রথে পুড়িয়ে দেয়।বর্তমানে নতুন নির্মিত রথ টেনে এ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

ইসকনের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র জানান, ১৯৮৯ সালে ইসকন রাজধানীতে প্রথম রথযাত্রা শুরু করে। প্রথমে ওয়ারীর গৌড়ীয় মঠে রথ গেলেও পরে ১৯৯২ সালে রথ যেতে শুরু করে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে।