স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চার প্রসার ও সাংগঠনিক কাঠামো তৈরিতে সদ্য প্রয়াত কাজী আরিফের অনন্য অবদানের কথা স্মরণ করেছেন আবৃত্তি অঙ্গনের অগ্রণী শিল্পীরা।
Published : 12 May 2017, 06:41 PM
শুক্রবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত কাজী আরিফের স্মরণসভায় এসে তারা বলছেন, যতদিন বাংলাদেশ আছে, ততদিন আবৃত্তিশিল্পীদের আবৃত্তির প্রতিটি পংক্তিতে স্মরণ হবেন কাজী আরিফ।
জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ আয়োজিত এ স্মরণসভায় যোগ দিয়ে সংস্কৃতি সংগঠকরা আবৃত্তিশিল্পের বিকাশে ‘অভিমানী আবৃত্তিকার’ কাজী আরিফের নানা অবদান তুলে ধরেন। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ পর্বে তারা শোনান কাজী আরিফের জীবনের অন্তরালের নানা গল্প।
স্মৃতিচারণ সভার শুরুতে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম ‘অসামান্য মানসিক শক্তিসম্পন্ন’ কাজী আরিফের এক রূপ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “মৃত্যুর তিনদিন আগে তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়নি তিনি প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ। আসলে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি সে জেনেও আমলে নেয়নি। তার মুখেই তো শোভা পায়, রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তি ‘মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান’।
“আমি যখন স্বাধীনতা পদক পেলাম, সেই তখন কেঁদে ফেলে বলেছিল- আশরাফ ভাই, মনে হচ্ছে, এই পদকটা আজ আমরা সবাই পেলাম।”
পরে তিনি জাহিদুল হকের ‘ফেরা’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
অনুসূয়া তার বাবাকে নিয়ে বলেন, “বাবা ছিলেন আমাদের শিক্ষক, আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দেশের বাইরে থাকার কারণে বাংলা শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অতটা ছিল না। কিন্তু আমরা যতটুকুই চর্চা করতাম, বাবা চাইতেন তা শুদ্ধভাবে করি।
“কোথাও ভুল হলে তিনি কড়াভাবে আমাদের ভুল ধরিয়ে দিতেন। এমনকি স্কাইপেতে যখন বাবার সাথে কথা বলি, তখনও বাবা বলতেন, তোমাদের উচ্চারণ ঠিক কর।”
অনুসূয়া বলেন, “বাবা হৈ-চৈ করে আনন্দ করতে খুব পছন্দ করতেন। বাবা বিশ্বাস করতেন, এই একটুখানি প্রশ্রয় দিলেই তো ব্যাপারটি ভালো হয়ে যায়। আপনারা সবাই বাবার হাসিমুখটি মনে রাখবেন।”
বাংলাদেশের আবৃত্তিশিল্পের ইতিহাসে কাজী আরিফকে কখনও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
“মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যতদূর সম্ভব তিনি কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন মানুষ, সে কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তার মধ্যে যে অভিমান ছিল যৌক্তিক ও সহজাত ছিল। আমরা তার সেই অভিমানের মূল্য দিতে পারিনি।”
ব্যক্তিপর্যায়ে নানা বিপন্নতায় অভিমানে কাজী আরিফ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মীরাই ‘ভুল বুঝে’ তাকে অদৃশ্য জগতের বাসিন্দা করে দিয়েছিলেন বলে অনুযোগ করেন তিনি।
হাসান আরিফ বলেন, “আবৃত্তিশিল্পের অগ্রগতিতে এগিয়ে যেতে হলে কাজী আরিফকে ধারণ করতে হবে। আবৃত্তিশিল্পীরা যখন আবৃত্তি করবেন, তখন তাদের প্রতিটি পংক্তিমালায় স্মরণ হবেন কাজী আরিফ। আমরা যেন জীবদ্দশায় তার কৃতিত্বের পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারি, আমরা যেন আর সৌভাগ্যবঞ্চিত না হই।”
বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল বলেন, “অভিমানী মানুষটি ছিলেন প্রচণ্ড স্পষ্টবাদী। কোনোকিছু মনমতো না হলে তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিতেন। অনেক আবৃত্তিশিল্পী তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রকৃত অর্থে আমরা এক অভিভাবককে হারিয়েছি।”
আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সংস্কৃতি অঙ্গনে সকলের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মানুষ। তার মতো আড্ডাবাজ, জীবন্ত এক মানুষের চলে যাওয়া সহজে মেনে নেওয়া যায় না। শিল্পাঙ্গনে আরিফের ছিল সদর্ভ উপস্থিতি।”
পরে তিনি আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পরিচয়’ কবিতাটি।
বাংলাবর্ষ ১৪০১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত বসন্ত উদযাপন ও চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজনে কাজী আরিফ ছিলেন অগ্রণী কর্মী। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই দুটি আয়োজনের আদ্যোপন্ত তুলে ধরেন উদযাপন পর্ষদের সহ-সভাপতি শফিউদ্দিন আহমেদ।
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের সভাপতি কাজী নাসির ও সাধারণ সম্পাদক কাজী এম আরিফ স্থাপত্যশিল্পে কাজী আরিফের অবদানের কথা তুলে ধরেন।
আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফার চোখে কাজী আরিফ ‘এক মহামানব’।
তিনি বলেন, “তার বড় দুর্দিনে আমি ছিলাম তার ভরসার জায়গায়। পরিচয়ের পর জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘটনায় তিনি আমাকে স্মরণ করতেন। তিনি আমাকে ভরসা করতেন, আমিও করতাম। আজ আর ভরসা করার কেউ রইল না। প্রেরণার উৎস চলে গেলেন। আমি কি আর কবিতা পড়ে কোনোদিন শান্তি পাব?”
স্মরণসভায় গান শোনান বুলবুল ইসলাম, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, আরিফ রহমান, মামুন জাহিদ খান, একক আবৃত্তি করেন মেহেদি হাসান ও দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে আবৃত্তির দল সংবৃতা।