পুরনো বছরের জরাজীর্ণতা আর পঙ্কিলতাকে মুছে দিয়ে ঐক্য ও অসাম্প্রদায়িকতার বন্ধনের বার্তা নিয়ে আসছে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪২৪; নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে চলছে প্রস্তুতি।
Published : 06 Apr 2017, 06:20 PM
প্রস্তুতি পর্বে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বলছেন, মৌলবাদ আর অপশক্তির প্রতিবাদে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে এক বড় প্রতিবাদ।
রংতুলির নানা কারুকার্যে লোকজ উপাদানগুলোকে সরাচিত্র, মুখোশ আর লোকজ নানা অনুষঙ্গে ফুটিয়ে তুলছেন অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এবারের শোভাযাত্রার ব্যাপ্তি হবে বিশাল। গত বছর নভেম্বরে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ’ এর স্বীকৃতি মিলেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার। আনন্দময় এ অর্জনকে সামনে রেখেই সাজানো হচ্ছে এবারের শোভাযাত্রা।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এ বছর এই শোভাযাত্রা পালিত দেবে দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায়।
চারুকলার শিক্ষক অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “এবারের শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য- ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’। সে সঙ্গে জঙ্গিবাদের মতো অন্ধকার শক্তির সঙ্গে যারা যুক্ত হচ্ছেন তাদেরও শুভবুদ্ধির উদয়ের আহ্বান জানানো হবে এ আয়োজনে। এ শোভাযাত্রা হবে অপশক্তির বিরুদ্ধে এক ব্ড় প্রতিবাদ।”
তিনি জানান, বিগত বছরগুলোতে যেসব শিল্পকাঠামো মঙ্গল শোভাযাত্রার সম্মুখভাগে ছিল, সেগুলোকে ফিরিয়ে আনা হবে।
১৯৮৯ সালের প্রথম শোভাযাত্রার ঘোড়া ও বিশাল বাঘের মুখ এবারের শোভাযাত্রায় থাকছে। থাকছে সমৃদ্ধির প্রতীক হাতি। এছাড়াও বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির শিল্পকাঠামোগুলোও এবার ফিরিয়ে আনা হবে।
এবারের শোভাযাত্রায় অনেকগুলো সূর্যের মুখের কাঠামো থাকবে। যার একপাশে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত মুখ থাকবে, অন্যদিকে থাকবে সূর্যের বিপরীতে অন্ধকার কদাকার মুখ। মানুষের অন্তনির্হিত এই দুই রূপ তুলে ধরা হবে এই কাঠামোগুলোতে।
এছাড়াও প্রকৃতির প্রতি সচেতনতার প্রতীক হিসেবে গাছ-পাখি-সূর্যের একটি শিল্পকাঠামো থাকবে। সে সঙ্গে মা-পুতুল, মাটির পাখি, হাতে ধরা মুখোশ- সবই থাকছে। এবারই প্রথম হাতে ধরা প্রতীকগুলোকে অংশগ্রহণকারীদেরকে উপহার হিসেবে দেওয়া হবে।’
চারুকলা অনুষদে প্রবেশ করতেই দেখা গেল উৎসবের ডামোডাল।
জয়নুল গ্যালারির সামনের উঠানে জলরংয়ে আঁকা ছবিগুলো থরে থরে সাজানো। আরেকদিকের টেবিলে সরাচিত্রে আপন মনে লোকজ নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। তৈরি হচ্ছে হরেক রকমের মুখোশ। সুতোয় ঝুলছে কাগজের পাখি।
বিশালাকৃতির শিল্পকাঠামো নির্মাণের জন্য কাঠ আর বাঁশের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। সব মিলিয়ে চারুকলাজুড়ে এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে।
অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী প্রীতম বলেন, “মঙ্গল শোভযাত্রার প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্ব চলছে এখন। আমরা চিত্রকর্ম, সরাচিত্র ও মুখোশ তৈরির কাজ শুরু করেছি। এগুলোর বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই শোভাযাত্রার খরচ তোলা হবে।”
চারুকলার শিক্ষকদের নির্দেশনায় শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছে অনুষদের আঠারো ও ঊনিশতম ব্যাচ, যাদের তত্ত্বাবধান করছেন পলাশ দত্ত।
প্রথা অনুযায়ী এবার সর্বশেষ দুইটি ব্যাচ মঙ্গল শোভাযাত্রার দায়িত্ব পালন করছে। এ বছর বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে চারুকলা অনুষদের চার শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে শিক্ষকরাও।
প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ চলছে। যত দিন যাবে ব্যস্ততা বাড়বে। সারারাত জেগে কাজ করতে হবে। এবারের শোভাযাত্রার ১২ থেকে ১৪টি শিল্পকাঠামো থাকছে। যার কাঠামোর কাজ চলছে, সেটি শেষ হলেই রংয়ের কাজ শুরু হবে।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র তহবিল গঠনে বিক্রি করার জন্য শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে পাখির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, সরার দাম ২৫০ থেকে ৬০০ টাকা, জল রঙে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্মের দাম ধরা হয়েছে ২,০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা এবং বিভিন্ন মুখোশের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা থেকে ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া হাত পাখা, বিভিন্ন শো-পিসও বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। যার দাম ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
এবারের শোভাযাত্রার নিরাপত্তার বিষয়ে নিসার হোসেন বলেন, “চর্তুদিকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তাই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। এর জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা আশা করছি।”
এবারে রমনা বটমূলের ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজনের পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি হচ্ছে। এজন্য পহেলা বৈশাখ সকাল সাড়ে ৯টার পর বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ আর বিশাল আকৃতির সব বাহন নিয়ে এ শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে বের হয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা) হোটেল চত্বর ঘুরে আবারও চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে।
১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের করা হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রথম শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। তারপরের বছরে চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়।
এসব শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। এরপর থেকে এটা বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম লাভ করে। গত বছর ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।