৭ বছর পর বড় ‘ধাক্কা খেলেন’ আরেফিন সিদ্দিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বিঘ্নে সাড়ে সাত বছর পার করলেও এই প্রথম বেকায়দায় পড়তে হল অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2016, 06:43 PM
Updated : 1 July 2016, 06:43 PM

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তার পদত্যাগের দাবি প্রথম উঠল, যে দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য তিনি।

আর বিষয়টি ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে, যাতে কার্যত জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করা হয়েছে জিয়াউর রহমানকে ‘দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখার মাধ্যমে।

সে কারণে আওয়ামী লীগের পদে থেকেও ছাত্রলীগের মিছিল থেকে ‘রাজাকার’ স্লোগান উঠল আরেফিন সিদ্দিকের নাম ধরে। 

জিয়াকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বলে তার ছেলে তারেক রহমানের বিতর্কিত দাবি তোলার এক বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্মরণিকায় এই কথা ছাপা হয়।

এ ঘটনায় ওই স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, “এটা বাইলাইন পাবলিকেশন ছিল। সেই প্রবন্ধের রচয়িতার ওপর দায় বর্তাবে।”

এভাবে পরিস্থিতি আপাত সামাল দিলেও এর রেশ থেকে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

শুক্রবার দিনভর ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন যে শান্ত-শিষ্ট পরিস্থিতি ছিল সেখানে এই ঘটনা উপাচার্যের জন্য বড় একটা ধাক্কা। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।” 

২০০৮ সালের ভোটে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপির আমলে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ বিদায় নিলে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আরেফিনকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয় সরকার।

ওই সময় উপ-উপাচার্য পদে আরেফিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ এবং কোষাধ্যক্ষ পদে মার্কেটিং বিভাগের মীজানুর রহমান নিয়োগ পান।

শুরুর দিকে দুই সহযোগীর সঙ্গে সমন্বয় ভালো থাকলেও ধীরে ধীরে সম্পর্কের অবনতি ঘটে উপাচার্য আরেফিনের। ওই সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন নীল দলের শিক্ষক নেতারাও উপাচার্যবিরোধী অবস্থান নেন। তবে শেষ পর্যন্ত টিকে যান আরেফিন সিদ্দিক। সরে যেতে হয় হারুন-মীজানুরকে।

দায়িত্ব পাওয়ার পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে স্যার এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের কোন্দলে শিক্ষার্থী আবু বকরের মৃত্যুর পরদিন একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভে নামলেও ছাত্রলীগ তাদের হলে পাঠিয়ে দেয়।

২০১০ সালের জুনে নতুন কমিটি হওয়ার পর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু আহত হন, আহত হন সে সময়ের প্রক্টর কে এম সাইফুল ইসলামও।

সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে মেট্টোরেল যাওয়ার বিরোধিতা করে একদল শিক্ষার্থীর গড়ে তোলা আন্দোলনের বিরুদ্ধেও ছাত্রলীগ মাঠে নামে।

এই সব অস্থিরতা ভালোভাবেই সামলে ওঠেন আরেফিন সিদ্দিক। এসব সময় যাদের পাশে পেয়েছিলেন এবার সেই ছাত্রলীগকর্মীরাই তার পদত্যাগ দাবিতে মাঠে নামে।

ভাংচুর করা হয়েছে উপাচার্যের গাড়ি, আরেফিন সিদ্দিক এ সময় গাড়িতে থাকলেও অক্ষত আছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মরণিকায় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখায় শুক্রবার সকালে বিক্ষোভের শুরু।

বিক্ষোভ-ভাংচুরের এক পর্যায়ে হামলার শিকার হয় শিক্ষার্থীদের ‘কাছের শিক্ষক’ হিসেবে পরিচিত উপাচার্য আরেফিনের গাড়ি। তিনি ভিতরে থাকা অবস্থায় ওই গাড়ির কাচ ভাঙা হয়।

প্রতিবাদের মুখে ওই স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ার পর উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শুরু হয় বিক্ষোভ।

বিকালে উপাচার্য বাংলোর ভিতরে অবস্থান করা অবস্থায় ফটকের বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। আরেফিন সিদ্দিককে ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করে তার পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দেন ছাত্রলীগকর্মীরা।

তবে সংবাদ সম্মেলন করে আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, স্মরণিকার ওই নিবন্ধ নামে প্রকাশ হওয়ায় তার লেখকের।

২০০৯ সালে আরেফিন সিদ্দিকের নিয়োগের প্রায় সাড়ে চার বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনের পর ২০১৩ সালের ২৫ অগাস্ট প্যানেলে থাকা তিনজনের মধ্যে আরেফিন সিদ্দিককে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আবদুল হামিদ। 

এর মাঝে উপ-উপাচার্য হারুণ-অর রশিদ ও কোষাধ্যক্ষ মীজানুর রহমানের পদত্যাগের পর ২০১২ সালের ৫ জুন চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান নাসরীন আহমাদ ও সহিদ আকতার হুসাইন। গত ৯ জুন তাদের মেয়াদ শেষ হলে নাসরীন আহমাদকে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছরের পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়, যার ৩০ জুন অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল।

নাসরীনের সঙ্গে এই দায়িত্বে আনা হয়েছে নীল দলের নেতা কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে।

১৯৫৩ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকায় জন্ম নেওয়া আরেফিন সিদ্দিক ১৯৬৯ সালে এসএসসি এবং ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ সালে বিএ এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে এমএ করেন তিনি।

১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেওয়ার আগে বুয়েটের পিআর ছিলেন আরেফিন সিদ্দিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের নীল দলের নেতা আরেফিন সিদ্দিক দুই মেয়াদে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান ও প্রেস ইনস্টিটিউটের সদস্যও ছিলেন তিনি।

উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার আগে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সম্প্রচার বিষয়ক বেশ কিছু জাতীয় কমিটিতেও ছিলেন তিনি।