ঢাবিতে ইতিহাস বিকৃতি: কর্মসূচি প্রত্যাহার ছাত্রলীগের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকায় ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের পদত্যাগ দাবিতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি বিক্ষোভের পর কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে ছাত্রলীগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2016, 04:57 PM
Updated : 1 July 2016, 04:57 PM

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা রাতে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এ ঘোষণা দেন।

শুক্রবার রাত ৯টার পর উপাচার্যের বাংলো থেকে বেরিয়ে ছাত্রলীগ সভপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, “স্মরণিকায় যে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের আদর্শ।

“আমরা ভিসির সঙ্গে কথা বলেছি। উনি আমাদের বলেছেন, যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের মধ্যে রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য যারা জড়িত, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্নে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, “ভিসিবিরোধী আন্দোলন আমাদের ছিল না। আমাদের আন্দোলন ছিল বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভুয়া তথ্য যারা উপস্থাপন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে।”

ছাত্রলীগ নেতাদের এই বক্তব্যের ঘণ্টাখানেক আগে তারা যখন ফটকের তালা খুলে উপাচার্যের বাংলোয় ঢোকেন, তখনও আরেফিন সিদ্দিকের পদত্যাগ দাবিতে সেখানে বিক্ষোভ করছিলেন সংগঠনটির প্রায় দেড়শ নেতাকর্মী।

আরেফিন সিদ্দিককে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তার পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন ছাত্রলীগ কর্মীরা।

সে সময় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি (উপাচার্য) প্রশাসনের সর্বোচ্চ জায়গায় রয়েছেন। এর ভুল তিনি এড়াতে পারেন না। এ কারণে উপাচার্যসহ যারা স্মরণিকা প্রকাশের সঙ্গে জড়িত তাদের সবার পদত্যাগ আমরা দাবি করছি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের স্মরণিকায় জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখায় শুক্রবার দুপুরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সড়কে আগুন জ্বালান ছাত্রলীগ কর্মীরা।

ঘটনার শুরু সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায়, দিবসটি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বের করা স্মরণিকায় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখা হয়, গত বছর লন্ডনে দলীয় সভায় যে দাবি তুলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন জিয়া-খালেদার ছেলে তারেক রহমান।

স্মরণিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে লেখা হয়, তিনি “বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেতা, যিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে বিবেচিত।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলকে ‘সংখ্যালঘুদের’ হল বলে পরিচয় দেওয়া হয় এতে।

বিষয়টি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠান মাঝপথে স্থগিত করা  হয়, উপাচার্য ওই স্মরণিকা বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ফেস্টুন রাস্তায় ফেলে যান চলাচল বন্ধ করে দেন বিক্ষোভকারীরা।

পরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা বেলা ১২টা থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারকে তার কার্যালয়ে তালাবন্ধ করে রাখে। পরে প্রক্টর গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন।

ছাত্রলীগ কর্মীদের বিক্ষোভের মধ্যে দুপুরে ভিসি বাংলোর সামনে ভাংচুরের শিকার হয় উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের গাড়ি। স্মরণিকার প্রকাশনার দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমানকে অব্যাহতির ঘোষণা আসে বিকালে।

এরপর উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দুপুরের পর থেকে ভিসির বাংলোর সামনে সমবেত নেতাকর্মীরা এক পর্যায়ে উপাচার্যের বাংলোর প্রধান ফটকের বাইরে তালা লাগিয়ে দেন।

ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আবিদ ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে বিক্ষোভে ‘ভিসি তুই রাজাকার/এই মুহূর্তে গদি ছাড়’, ‘হই হই রই রই/ভিসি তুই গেলি কই’, ‘এক দফা এক দাবি/ভিসি তুই কবে যাবি’, ‘আমার সোনার বাংলায়/আরেফিনের ঠাঁই নাই’, ‘রাজাকার আরেফিন যেখানে/ লড়াই হবে সেখানে’, ‘আরেফিন তুই বেরিয়ে আয়/ধোলাই হবে রাস্তায়’, ‘আরেফিনের চামড়া/তুলে নেব আমরা’, ‘আরেফিনের গালে গালে/জুতা মার তালে তালে’ প্রভৃতি স্লোগান দেওয়া হয়।

বিক্ষোভের মধ্যে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ইতিহাস বিকৃতির দায় ওই নিবন্ধের লেখকের।

বিক্ষোভকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ইফতার করেন উপাচার্যের বাংলোর সামনের রাস্তায়। এ সময় খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো তাদের উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে ছুড়ে ফেলতে দেখা যায়।

এর মধ্যে বিকালে বাংলোর মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্মরণিকার ওই নিবন্ধটি নামে প্রকাশিত হওয়ায় দায় লেখকের।

স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতির কথা জানিয়ে এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

এরপরেও তার পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভের মধ্যে পরে রাত সোয়া ৮টার দিকে বাংলোর ফটকের তালা খুলে ভিতরে যান ছাত্রলীগে কেন্দ্রীয় সভাপতি সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির। সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ দুই নেতাকেও সঙ্গে নেন তারা।

২০০৮ সালের ভোটে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপির আমলে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ বিদায় নেন। এরপর ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিককে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয় সরকার।

এর প্রায় সাড়ে চার বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। নির্বাচনের পর ২০১৩ সালের ২৫ অগাস্ট প্যানেলে থাকা তিনজনের মধ্যে আরেফিন সিদ্দিককেই ফের চার বছরের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে তার।