বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন ও মুসলিম উম্মাহর জন্য একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
Published : 05 Jun 2016, 10:15 PM
বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন ও মুসলিম উম্মাহর জন্য একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ।
রোববার স্থানীয় সময় দুপুরে জেদ্দায় সৌদি বাদশাহর বাসভবন আল সালাম প্যালেসে দুই দেশের নেতার মধ্যে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকে এ অঙ্গীকার আসে।
বৈঠক শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে আসেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়েছে। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দুজনের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং সৌদি বাদশাহ বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন এবং ইসলামি উম্মাহর জন্য একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।
“একইসাথে বিশ্বে এখন যে অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা- এই ক্ষেত্রে কাজ করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী ও বাদশাহ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।”
বাংলাদেশকে সৌদি আরব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে জানিয়ে শহীদুল হক বলেন, “শুরুতেই কিং সালমান বলেছেন, সৌদি আরব বাংলাদেশকে শীর্ষ সারির একটি মুসলিম দেশ মনে করে এবং তিনি বলেছেন, মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।
“একইসাথে উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুদেশের যে অপার সম্ভাবনা আছে, তা বাদশাহ বারবার উল্লেখ করেছেন এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলেছেন উনি দুবার।”
সৌদি বাদশাহ মনে করেন, বিশ্বে শান্তি, প্রগতি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটা বড় ভূমিকা আছে।
“এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, একটা শক্তিশালী সম্পর্ক উন্মুক্ত, যেটা আমরা আগে ঠিক এভাবে দেখিনি,” বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, “এটা অত্যন্ত যুগান্তকারী সফর হয়েছে। আমরা যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তারও অনেক বেশি সফলতা এসেছে বলে আমার মনে হয়। এই সফরের মধ্য দিয়ে শুধু নতুন অধ্যায়ই উন্মুক্ত হয়নি, আমাদের সম্পর্ক ইতোমধ্যে একটা নতুন উচ্চতায় চলে গেছে।”
শেখ হাসিনা সৌদি বাদশাহকে বলেছেন, বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে সৌদির সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
একইসঙ্গে সৌদি আরব ইসলামিক অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ‘সোচ্চার’ হয়েছেন সে বিষয়টিও শেখ হাসিনা তুলে ধরেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ যে এটাতে (সামরিক জোটে) অংশগ্রহণ করেছে, এতেই সৌদি রাজ অত্যন্ত আনন্দিত।”
বাদশাহ সালমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে, তার প্রশংসাও করেন।
“বাদশাহ বলেছেন, জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সৌদি আরব গুরুত্ব দেয়। তিনি মনে করেন, এর ফলে দুই দেশের মধ্যে একটা সুদূরপ্রসারী কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সৌদি আরব আমাদের হৃদয়ে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকে। কারণ, এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জন্মস্থান ও দুটো পবিত্র মসজিদ।”
সৌদি আরবে বিমানবন্দরে ক্রাউন প্রিন্সের অভ্যর্থনা, গার্ড অব অনার, লাল গালিচা এবং সেখান থেকেই নৈশভোজে নিয়ে যাওয়ার মতো সম্মান বাংলাদেশের কোনো সরকার প্রধানের ক্ষেত্রে এই প্রথম দেখানো হল বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, “যেভাবে বাদশাহর তত্ত্বাবধানে দ্বি-পাক্ষিক এ সফর তাও গত তিন দশকে হয়নি।”
প্রধানমন্ত্রী জেদ্দায় রাজকীয় জেদ্দা কনফারেন্স প্যালেসে রয়েছেন। সেখান থেকে দুপুর ১টায় বাদশাহর প্রাসাদে যান তিনি।
শহীদুল হক বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বাদশাহর কাছে তার চারটা চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।”
এর মধ্যে রয়েছে- ‘সত্যিকার ইসলাম’ সবার কাছে পৌঁছে দিতে এবং ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা প্রতিহত করতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতিটা জেলা ও উপজেলায় ৫৬০টি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে চান।
“এটা শোনার পর বাদশাহ অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন এবং বলেছেন, হ্যাপি টু কো-অপারেট ইন দিস। উনি বলেছেন, উনার সিনিয়র মন্ত্রীকে পাঠাবেন বিষয়টি দেখার জন্য।”
“প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় অ্যারাবিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা তুলে ধরে বলেছেন, তিনি আরবি ভাষা, কালচার ও ইসলাম ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করতে চান; যাতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডাকে দূরীভূত করা যায়। একইসাথে বাংলা, ইংরেজি ও অ্যারবিতে ডিজিটাল কোরআন শরিফ অনলাইনে পড়ার ব্যবস্থা করার কথাও বলেন তিনি।”
“এটা শুনে বাদশাহ অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন এবং বলেছেন যে, এ বাপারে উনার কোনো সহযোগিতা করার থাকলে উনি করবেন।”
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বলেছেন। সেখানে সৌদি আরবের জন্য একাধিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। যেখানে সৌদি বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও তথ্যৎপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
বৈঠকে সৌদি বাদশাহ আরবিতে কথা বললেও তিনি শেখ হাসিনাকে ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার’ বলে সম্বোধন করেন বলে জানান শহীদুল হক।
তিনি বলেন, “এই সফরের মধ্য দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে নেতৃত্ব সেটা সম্পর্কে আমরা আরও একবার একটা বড় ধরনের বিশ্ব স্বীকৃতি দেখলাম। আমি মনে করি যে এর মধ্য দিয়ে শুধু সৌদি আরব নয়, মুসলিম উম্মাহর সাথে নতুন ধরনের একটা সম্পর্কের সূচনা হল।”
সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বৈঠকে বোন শেখ রেহানা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।
বিকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌদি অর্থমন্ত্রী ইবরাহিম বিন আবদুল আজিজ সৌজন্য সাক্ষাতে এলে সেখানে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানান শহীদুল হক।
“উনাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি উনারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন।”
সরকারি হিসাবে বর্তমানে ১২ লাখ ৮০ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরবে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এই হিসাবে সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার সকালে মদিনার উদ্দেশে জেদ্দা ত্যাগ করবেন। তিনি সেখানে মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রওজা জিয়ারত করবেন।
মঙ্গলবার সকালে মদিনার প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন আব্দুল আজিজ বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছনোর কথা রয়েছে তার।
সৌদি বাদশাহ সালমান দায়িত্ব নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের এই তেলসমৃদ্ধ দেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম সফর। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নভেম্বরে ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
এই সফরের শুরুতেই মক্কায় ওমরাহ পালন করেন তিনি। এরপর জেদ্দায় ফিরে সেখানে থেকেই তিনি রিয়াদে বাংলাদেশের চ্যান্সেরি কমপ্লেক্স এবং বাংলাদেশ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।