শ্রদ্ধা ভালোবাসায় শেষ ঘুমে খালেদা একরাম

বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক খালেদা একরামের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও বিশিষ্টজনেরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2016, 03:30 PM
Updated : 25 May 2016, 04:09 PM

বুধবার বিকেলে প্রয়াত শিক্ষাগুরুর ৪৪ বছরের কর্মস্থল স্থাপত্য বিভাগ প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদন চলে ঘণ্টাব্যাপী।

শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে সেশনজট ও দুর্নীতিমুক্তসহ বুয়েটে যে পরিবর্তনের ধারা খালেদা একরামের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তা এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান আর প্রত্যয় ছিল সবার কণ্ঠে।

‘নন হজকিনস লিমফোমা’সহ নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভুগে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ৫ মিনিটে ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতালে মারা যান খালেদা একরাম, যিনি ছিলেন বুয়েটের ১২তম উপাচার্য।

বুধবার বেলা সোয়া ১২টায় থাইএয়ারের একটি বিমানে নিয়ে আসা হয় তার মরদেহ। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বুয়েট উপাচার্যের বাসভবনে।

বিকাল ৪টার দিকে স্থাপত্য বিভাগের সামনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য জড়ো হন শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। শ্রদ্ধা নিবেদন স্থলে রাখা ছিল খালেদা একরামের একটি ছবি, যাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘পরিবর্তনের ধারা বয়ে যাক আবহমানকাল’।

শিক্ষামন্ত্রীসহ অন্যদের বক্তব্যের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজন হয়ে উঠে অনানুষ্ঠানিক স্মরণসভায়।

বক্তৃতা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মিয়া মো. জয়নুল আবেদীনের শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে পুষ্পস্তবক অর্পণের সূচনা হয়।

এরপর একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, বুয়েট অ্যালামনাই সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ, বুয়েটের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য জেবুন নাসরীন আহমদসহ অনেকে।

শ্রদ্ধা জানায় বুয়েট শিক্ষক সমিতি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ‍স্থপতি ইনস্টিটিউট, বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ, বুয়েটের কর্মচারী সমিতি, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনও।

বৃষ্টির কারণে খেলার মাঠ থেকে পরিবর্তন করে বাদ আসর বুয়েট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। পরে  রাতে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে সমাহিত করা হয় অধ্যাপক খালেদাকে।

শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে বক্তব্যে খালেদা একরামকে স্মরণ করে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “শিক্ষা পরিবারে যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে তার মধ্যে বুয়েটকে আমরা সবসময় শীর্ষ হিসাবে ধরে নিই। শীর্ষ এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় সফল হওয়া আমাদের সকলেরই সফলতা। অধ্যাপক খালেদা একরাম তার কাজে সফল হয়েছেন।

“দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে উনি কাজ করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে আকস্মিকভাবে হারিয়েছি।”

তিনি বলেন, “যতটুকু জেনেছি, তিনি তার শারীরিক কষ্টটা আমাদের বুঝতে দেননি। এ কারণে এভাবে খারাপ অবস্থার মধ্যে যাওয়া আমরা বুঝতে পারিনি। ওনার মৃত্যুতে আমরা শিক্ষা পরিবার শোকাহত।”

স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, “উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘ইয়াফেস ভাই, আমি পারবো তো?’ আমি বলেছিলাম, ‘স্থপতিরা মানুষের মন ও সৌন্দর্য নিয়ে কাজ করে, আপনারও অসুবিধা হবে না’।

“কেবল বুয়েট নয়, মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজেও তিনি সহায়তা করেছেন। বড় ব্যাপার হচ্ছে, তিনি একজন ভাল মানুষ ছিলেন।”

তিনি বলেন, “তার সঙ্গে আমার সপ্তাহে দুই-তিনবার ফোনালাপ হতো। গত ২০ মাসে উপাচার্য হিসাবে তার কাজে যে একাগ্রতা ছিল, তিনি যদি বেঁচে থাকতেন যেকোনো উপাচার্যের চেয়ে বেশি কাজ করতে পারতেন।”

“বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের অনেকক্ষেত্রে তার সহায়তা পেতে পারতাম। তার অকাল প্রয়াণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।”

বুয়েট অ্যালামনাই সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, “বুয়েটে খালেদা একরামের আগে ১১ জন উপাচার্য ছিল। যাদের মধ্যে ৩ জনকে আমরা হারিয়েছি। তিনি প্রথম উপাচার্য, যিনি কর্মরত অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

“অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বুয়েটের উন্নয়নে তার সঙ্গে মিলে আমরা অনেক পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। যেকোনো বিষয়ে সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে সমাধান করা যায় সেই চিন্তা তার মধ্যে ছিল। স্বল্প সময়ে তিনি বুয়েটের জন্য যা করেছেন এটা বুয়েটের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান পাবে।”

নিজের ছাত্রী হিসাবে খালেদা একরামকে পাওয়ার কথা জানিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, “আমি স্থাপত্য বিভাগের ক্লাস নিতাম না। তবে উনি যে ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন সে ব্যাচের একটি ক্লাস নিয়েছিলাম। খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। যতদূর মনে পড়ে, আমার কোর্সে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল।”

খালেদা একরামের জ্যেষ্ঠ মেয়ে মরিয়ম খালিদ প্রয়াতের অসুস্থতার সময়ে সকলের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, “আপনারা আমার মায়ের জন্য এতো করেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাদের সহযোগিতা না পেলে এতোদূর আসতে পারতাম না।”

বুয়েটে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সেশনজট কমিয়ে ঠিক সময়ে একাডেমিক সেশন শুরু এবং শেষ করাকে খালেদা একরামের সবচেয়ে বড় অবদান বলে উল্লেখ করে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজ।

এ সময় অন্যদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক জেবুন নাসরীন আহমদ, কর্মচারী সমিতির নেতা শাহীন আলম বক্তব্য দেন।

১৯৭৪ সালে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করা অধ্যাপক খালেদা পরের বছর ওই বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।

১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর পাস করা খালেদা উপাচার্য হিসাবে যোগ দেন ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর।

১৯৫০ সালের ৬ অগাস্ট ঢাকায় জন্ম নেওয়া খালেদা ইকরামের বাড়ি বগুড়ায়।