জন্মদিনে শহীদ জননীকে উৎসর্গ যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডের রায়

যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির আন্দোলনের নেতৃত্বদাতা শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে কিশোরগঞ্জের পাঁচ রাজাকারের দণ্ডের রায় উৎসর্গ করেছে প্রসিকিউশন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 09:46 AM
Updated : 3 May 2016, 09:52 AM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার এই মামলার রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন সাংবাদিকদের বলেন, “এই মামলার সাতটি অভিযোগের সবগুলো আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। আদালত চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে।”

একাত্তরে কিশোরগঞ্জে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন আইনজীবী শামসুদ্দিন আহমেদ, তার ভাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, গাজী আব্দুল মান্নান ও হাফিজউদ্দিন। মামলার অপর আসামি আজহারুল ইসলামকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

দণ্ডিতরা একাত্তরে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বিদ্যানগর, আয়লা, ফতেপুর বিল, কিরাটন বিলসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটান, তা এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।

শহীদ জননীর জন্মদিনে তাদের সাজা ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, আজকের এই পবিত্র দিনে তার আত্মা শান্তি লাভ করবে। আমার বিশ্বাস, একাত্তরের যে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।এই রায়টি আমরা আমাদের শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে উৎসর্গ করতে চাই।”

লেখক জাহানারা ইমাম (ডাক নাম জুডু) ১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আব্দুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শফী ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক।

কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ 'গণআদালত' গঠন করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের 'নরঘাতক' গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার শুরু করে।

গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম তার (গোলাম আযম) ১০টি অপরাধই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

ওই সময় জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

গণআদালতের অন্য সদস্যরা ছিলেন-  অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, সেক্টর কমান্ডার কাজী নুরুজ্জামান ও আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান প্রমুখ।

গণআদালতের এই বিচার পরিচালনা করায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার জাহানারা ইমাম ও সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে।

‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র  এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘শহীদ জননী’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন মুক্তিযুদ্ধে ছেলে গেরিলা যোদ্ধা রুমিকে হারানো এই মা।

জাহানারা ইমামের আত্মজীবনীমূলক লেখা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অসাধারণ দলিল হিসেবে দেখেন ইতিহাসবেত্তারা।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ গণজাগরণেও প্রেরণায় ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেওয়ার পর গড়ে উঠা শাহবাগের বিক্ষোভ বিরতিহীনভাবে ২০০ ঘণ্টায় পা দেওয়ার পূর্বক্ষণে সেখানে শহীদ জননীর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।