আঁটঘাট বেঁধেই জুলহাজ মান্নানকে হত্যা করতে এসেছিল খুনিরা, একটি সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবিতে তাদের সবার সামনে দিয়েই দৌড়ে যেতে দেখা গেছে।
Published : 26 Apr 2016, 10:29 PM
দিনের বেলায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তার বন্দোবস্ত থাকা ভবনে খুনের পর সবার সামনে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ওই যুবকরা এসেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে।
হত্যাকাণ্ডের পরদিন মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে সব দেখেশুনে পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হকও সাংবাদিকদের বলেছেন, “অত্যন্ত সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ধারণা করছি, রেকি করে খুনিরা খুনের পরিকল্পনা করেছে।”
নিহত জুলহাজ মান্নানের ভাই ডিএসইর সাবেক সহসভাপতি মিনহাজ মান্নান বলেন, “খুনিরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বলে মনে হয়েছে। তারা সুসংগঠিত ছিল, পরিকল্পিতভাকে হত্যা করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে তাদের যদি কোনো ক্ষতি সাধনও হয়, তার জন্যও তারা প্রস্তুত ছিল।”
কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের যে বাড়িতে সোমবার বিকালে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে হত্যা করা হয়, তার সামনের রাস্তায় যাতায়াত ছিল মানুষের, গলির মধ্যে অনেক দোকানও ছিল খোলা।
ওই বাড়ির কাছেই ছিল তেঁতুলতলা মাঠ, যেখানে শিশুরা খেলছিল তখন। অনেক মানুষও ছিল ওই মাঠে। সবার সামনে দিয়েই পালিয়ে যায় খুনি অন্তত পাঁচজন যুবক। বাধা দিতে চাইলেও তাদের গুলিবর্ষণে অনেকে পিছু হটেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ ৯০ বছর বয়সী মাকে নিয়ে লেক সার্কাসের ছয়তলা ভবন আছিয়া নিবাসের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন। বাড়িতে একজন গৃহকর্মীও ছিলেন।
সমকামীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার জুলহাজের বাড়িতে হামলার সময় ওই বাড়িতে ছিলেন তার বন্ধু নাট্যকর্মী তনয়। হামলাকারী যুবকরা দুজনকে কুপিয়ে মেরে চলে যায়।
পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালের একটু পশ্চিম দিকে বিপরীত পাশের গলি ধরে পাঁচ মিনিটের মতো হাঁটলেই আছিয়া নিবাস। বাড়িটিতে সিসি ক্যামেরা না থাকলেও নিরাপত্তার জন্য ফটকে সারাক্ষণ পাহারাদার থাকে। ফটকটিও বেশ মজবুত দেখা গেছে।
বাড়ির দারোয়ান পারভেজ মোল্লার বক্তব্য অনুযায়ী, খুনিরা পার্সেল দেওয়ার কথা বলে এসেছিল। দরজা খুলে দেখে সন্দেহ করে জুলহাজ আটকে দেওয়ার চেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। খুনিরা জোর করে ঢুকে হত্যা করে চলে যায়।
চিৎকার শুনলেও গুলির শব্দ পেয়ে তারা কেউ ভয়ে বের হননি বলে ওই ভবনের বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী এক নারী বলেন, ৫/৭ জন যুবককে অস্ত্র হাতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে গুলিবর্ষণ করে বেরিয়ে যেতে দেখেন তিনি। টি শার্ট ও জিন্স পরা, কাঁধে ব্যাগ বহনকারী ওই যুবকরা তেঁতুলতলা মাঠ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
মঙ্গলবার ওই এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি খুনিদের সরাসরি দেখেছেন, তাদের চিৎকার শুনেছেন। এমনকি প্রকাশ্যে চাপাতি হাতে তাদের সড়ক দিয়ে যেতেও দেখেছেন।
আছিয়া নিবাসের কয়েকশ গজ দূরের ডলফিন গলির একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায় পাঁচ যুবকের দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়েছে। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা ছিল খুনি।
যুবকদের পালানোর ওই দৃশ্য বিকাল ৬টার দিকের। তাতে ধারণা করা যায়, বিকাল পৌনে ৬টার দিকে জুলহাজ ও তনয়কে হত্যা করা হয়েছে।
ভিডিওতে ওই যুবকদের পালানোর কয়েক সেকেন্ড আগে পুলিশের একটি গাড়িকে দেখা যায় ওই যুবকেরা যে দিক থেকে এসেছিল, সে দিকে যেতে।
আবার যুবকরা চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুলিশের একটি গাড়িকেও সেদিকে যেতে দেখা যায়। তবে পুলিশের দুটি গাড়ি কি একই কি না, তা বোঝা যায়নি।
হামলাকারী যুবকরা পালানোর সময় তাদের একজনকে টহল পুলিশের এএসআই মমতাজ জাপটে ধরেন বলে আগের দিনই পুলিশ জানিয়েছিল।
তবে তিনি ওই যুবককে ধরে রাখতে না পারলেও ব্যাগটি রেখে দিতে পেরেছিলেন। হামলায় এএসআই মমতাজ আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ওই ব্যাগে একটি পিস্তল, একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মোবাইল ফোন পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। একে খুনি ধরার ক্ষেত্রে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলামত’ বলছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।
ভিডিওতে প্রথমে চার যুবককে দৌড়ে যেতে দেখা যায়, তার কয়েক সেকেন্ড পর যেতে দেখা যায় সন্দেহভাজন খুনিদের সর্বশেষ জনকে।
ভিডিওতে ওই সময়ে কয়েক জনের সন্দেহজনক গতিবিধি ধরা পড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ওই এলাকার একটি দোকানের মালিক আবদুর রহমান তখন আছিয়া নিবাসের কাছের উত্তর ধানমন্ডি জামে মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে বেরিয়েছিলেন।
জামে মসজিদের ঠিক বিপরীতে তেঁতুলতলা ঈদগাহ মাঠে শিশু-কিশোরদের তখন খেলাধুলা করতে দেখেছিলেন তিনি। তার দাবি, গরমের মধ্যে তখন ওই মাঠসহ আশপাশের এলাকায় অন্তত দেড়শ মানুষ ছিল।
আবদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হঠাৎ দেখি নীল গেঞ্জি পরা অন্তত পাঁচটা ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী যুবক ছেলে ‘এনা কিংডম’ (কাছের একটি ভবন) পার হচ্ছে। ওরা ‘নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর’’ বলে চিৎকার করছিল। এলাকার কয়েকটা ছেলে ‘ধর ধর’ বলে চিৎকার করে এগিয়ে গেলে ওরা অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়ে।”
গুলিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় ওই যুবকরা কোন দিকে গেছে, তা আর দেখতে পারেননি রহমান।
ওই এলাকার একটি ভাঙারি দোকানের মালিক হারুন বলেন, “ওই ছেলেরা ডলফিন গলির দিকে ছুটে যায়। প্রথমে ওদের হাতে চাপাতি দেখার পর ডাকাত মনে হয়েছিল। ওদের ধরতে কয়েকজন দোকান থেকেও বের হই। কিন্তু ওরা গুলি ছুড়লে ভয়ে সরে যাই। ওরাও পালিয়ে যায়।”
নিহত জুলহাজের বাসার ঠিক নিচে মিম টেইলার্সের মালিক ইয়াসমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকালে চিৎকার শোনার পরই দোকানের শাটার লাগিয়ে দেই। ভয়ে সারা শরীর কাঁপছিল। কারণ, ডাকাত হলে তো তারা প্রথমে আমার দোকান আক্রমণ করবে।
“ওই বাসায় (জুলহাজের বাসা) হিজড়ারা প্রায়ই যাতায়াত করত। একবার ভেবেছি, হিজড়াদের মধ্যে হয়ত কোনো মারামারি হয়েছে।”
চিৎকার শোনার অন্তত ১০ মিনিট পর পরিস্থিতি শান্ত দেখে দোকান খুলে ঘটনাটি শোনেন তিনি।
ওই বাড়ির কয়েক কদম দূরের আরেকটি দোকানের মালিক মমিনুল হক বলেন, “বিকালে দেখি কয়েক যুবক ওই বাসা থেকে বের হচ্ছে। ওই সময় চিৎকার শুনে ভেবেছিলাম, কোনো বাসায় ডাকাতি হচ্ছে। ভয়ে দোকান বন্ধ করে বসে ছিলাম।”
হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারী এই যুবকরা কারা, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার নামে দায় স্বীকারের বার্তা এলেও পুলিশ বরাবরই এসব দাবি উড়িয়ে দিয়ে আসছে।
কয়েকদিন আগে রাজশাহীতে একইভাবে অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী এ এফ এম রেজাউল করিমকে হত্যার পর আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এসেছিল।
তা উড়িয়ে দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের জঙ্গিরাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আইএস কিংবা আল কায়দার নামে বার্তা দিচ্ছে।
অধ্যাপক রেজাউলের মতো পথে এই বছরই হত্যা করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে।
এর আগে গত বছর অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয় পথে। নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয় এবং ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করা হয় ঘরের মধ্যে।