খুনি ‘দক্ষ, প্রশিক্ষিত’

কোথায় আঘাত করলে দ্রুত মৃত্যু হয়, সেই প্রশিক্ষণ নিয়েই খুনিরা সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়েছে বলে মনে করছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2016, 06:43 AM
Updated : 26 April 2016, 08:03 AM

মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “দক্ষ হাতের কাজ, খুনিরা প্রশিক্ষিত। কোথায় আঘাত করলে মারা যাবে, সে ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা কুপিয়েছে।”

সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেক সার্কাস এলাকায় পার্সেল দেওয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) ও তার বন্ধু তনয়কে (২৬)।

পাঁচ থেকে সাতজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য।

লাশের সুরতহাল করার পর কলাবাগান থানার এস আই মো. আনসার আলী তার প্রতিবেদনে বলেছেন, ঘাড়, চিবুক, মাথার সামনে পেছনে ও উপরের অংশে বিভৎসভাবে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে ঘটনাস্থলে।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ বলেন, “এ ধরনের আঘাতের পর কারও বেঁচে যাওয়া সম্ভব নয়। একই স্থানে উপর্যুপরি কয়েকটি আঘাত ছিল। এবং সেই আঘাত মাথার খুলি কেটে মগজ পর্যন্ত পৌঁছেছে। তনয়ের স্পাইনাল কর্ড ছিঁড়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “একই স্থানে অন্তত তিনটি আঘাত করলে মগজ স্পর্শ করে। খুনিরা ভালো করেই জানে এবং জেনেই আঘাতগুলো করেছে।”

সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলহাজের মাথার পেছনে ও চিবুকের বাঁ দিকে ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ধারালো কোপের চিহ্ন রয়েছে। আঘাত এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে খুলি কেটে মগজ বের হয়ে এসেছে।

মাথার পেছনে ডান দিকে কানের উপরের অংশেও পাশবিকভাবে কোপানো হয়েছে ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজকে।

তার বাঁ হাতের মধ্যভাগে ধারালো অস্ত্রের কাটা দাগ পাওয়া গেছে, যা থেকে মনে হয়, স্বাভাবিকভাবেই কোপ ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। 

ইউএসআইডিতে যোগ দেওয়ার আগে জুলহাজ ছিলেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রটোকল অ্যাসিসটেন্ট। সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন তিনি।

লেক সার্কাস রোডের যে বাসায় জুলহাজ খুন হন, সেখানে মাকে নিয়ে তিনি থাকতেন।

হত্যাকাণ্ডের পর টি শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরিহিত পাঁচ থেকে সাতজনকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে বলতে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছেন বলে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন।

ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার ধারণা, জুলহাজকে হত্যার জন্যই খুনিরা ওই বাসায় গিয়েছিল বলে ঘটনাপ্রবাহে তাদের মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জুলহাজের সঙ্গে থাকার কারণেই হয়তো খুন হতে হয়েছে লোকনাট্য দলের কর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে।

এস আই মো. আনসার সুরতহাল প্রতিবেদনে বলছেন, তনয়ের মাথার পেছনের অংশ থেকে ঘাড় হয়ে প্রায় এক ফুট পরিমাণ জায়গা প্রায় চার ইঞ্চি গভীর হয়ে কেটে গেছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে।

এছাড়া মাথার উপরের অংশেও পাঁচ ইঞ্চি দ্যৈর্ঘ্যের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে; কোপের কারণে কেটে গেছে খুলি।

এর আগে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, লেখক অভিজিৎ রায়, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়,প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনসহ বিভিন্ন হত্যার ঘটনায় লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা একই ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা বলেছিলেন।  

প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিকল্পিত ও আকস্মিক হামলায় দক্ষ হাতে চাপাতির কোপে মৃত্যু নিশ্চিত করে দ্রুত পালিয়ে গেছে খুনিরা।

ডা. সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেটে অনন্ত বিজয় ছাড়া বাকি সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্ত আমি করেছি। সবগুলো ক্ষেত্রে খুনের ধরণ একই।”

এসব ঘটনার প্রায় প্রতিটিতেই তদন্তকারীরা ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের সংশ্লিষ্টতার কথা বলেছেন।

জুলহাজের চাচা আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার ভাতিজাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

আর তনয়কে মিরপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন তার চাচা খন্দকার ফজলুর রহমান।