যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ, যার মধ্যে দিয়ে দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরুর পথ তৈরি হল।
Published : 15 Mar 2016, 03:20 PM
আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকালে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। সন্ধ্যায় তা ট্রাইবুন্যালে পাঠানো হয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মো. শহীদুল আলম ঝিনুকের হাতে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পৌঁছে দেন।
ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করার পর রায়ের প্রত্যায়িত কপি পাঠানো হবে কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। নিয়ম অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অবহিত করা হবে।
আপিল বিভাগের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হাতে পেয়ে বিচারিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল) কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবে। ওই মৃত্যু পরোয়ানার ভিত্তিতেই সরকারের তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ সাজা কার্যকরের প্রস্তুতি নেবে।
অবশ্য দণ্ড কার্যকরের আগে আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগ পাবেন একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী। রিভিউ না টিকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষাও তিনি চাইতে পারবেন।
দুই আর্জিই নাকচ হলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে। তার আগে আসামির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন পরিবারের সদস্যরা।
একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নে ভূমিকাসহ তিন অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় আসে সর্বোচ্চ আদালত থেকে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৬ জানুয়ারি এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়। ১৫৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেছেন এ বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
নিয়ম অনুযায়ী, আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।
বুধবার থেকে সেই দিন গণনা শুরু হবে জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সময়ের মধ্যে কেউ রিভিউ আবেদন না করলে আইন অনুসারে দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করবে সরকার।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, “রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে ১৫ দিনের মধ্যে আমরা রিভিউয়ের আবেদন করব।”
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মোট ছয়জনের আপিলের নিষ্পত্তি শেষে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়ে রিভিউয়ের পর্যায়ে এলো।
চূড়ান্ত রায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছর জানুয়ারিতে আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সেই ফাঁসির রায়ই বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটিতে নিজামীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় আসে। আর অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আপিলের রায়ে ২, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে প্রায় পাঁচশ মানুষকে হত্যা ও ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ এবং পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রাখে সর্বোচ্চ আদালত। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বহাল রাখা হয় ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে।
১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ।
যে তিন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
অভিযোগ-২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
অভিযোগ-৬: নিজামীর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে যায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা। তারা গ্রামের ডা. আব্দুল আউয়াল ও তার আশেপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা করে।
অভিযোগ-১৬: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা ওই গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
জামায়াত আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে।
৭২ বছর বয়সী নিজামী আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের এই মন্ত্রী চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারও মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি।
নিজামী হলেন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা তৃতীয় ব্যক্তি, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে যার সামনে অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি। আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে এটি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বিতীয় রায়।