উত্তরের বন্যায় পানিবন্দি কয়েক লাখ, অপ্রতুল ত্রাণ

“ঘরের খোঁজ কেউ নেয় না, ১২ দিন হল বানের পানিত ডুবি আছি। কেউ এক ছাঁটাক চাউলও দিল না”- এভাবে ক্ষোভ জানালের সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের ঘাঘট নদী পাড়ের পুরাণ লক্ষ্মীপুর গ্রামের আব্দুস ছাত্তার। একই অভিযোগ কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার আরও অনেক বানভাসী মানুষের

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিগাইবান্ধা/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2015, 06:27 AM
Updated : 5 Sept 2015, 06:31 AM

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরের নদ-নদীরগুলোর পানি বাড়ায় গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে আছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন উঁচুস্থানে, সড়ক, বাঁধের উপর।

বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত টানা বষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বেড়ে গাইবান্ধার সাতটি উপজেলার ৮২ ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টি ইউনিয়নের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে।

প্রায় আড়াই লাখ লোক পানিবন্দি অবস্থায় এখন চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে বলে জানান গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল মিয়া। 

কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলার তিন শতাধিক গ্রামের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে আরও নতুন নতুন এলাকা।

খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা।

গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান,  দুসপ্তাহের এই টানা বন্যায় জেলার প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, বীজতলা, শাক-সবজি, আদা ও কলার ক্ষেত নষ্ট হয়েছে।

এদিকে এক দশক ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো সংস্কার না করায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পানি ভেতরে ঢুকে গোটা জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।

সাদুল্লাপুর উপজেলার কামারপাড়া ইউনিয়নের ঘাঘট নদী পাড়ের পুরাণ লক্ষ্মীপুর গ্রামের আব্দুস ছাত্তার বলেন, “হামার ঘরের খোঁজ কেউ নেয় না, ১২ দিন হল বানের পানিত ডুবি আছি। কেউ এক ছাঁটাক চাউলও দিল না। গোটা গাঁও পানির তলোত; তাই কামও নাই, ঘরোত খাবারও নাই।

“ছোলপোল নিয়্যা খ্যায়া না খ্যায়া দিন পার হতেছে।”

আর একটু এগিয়ে দেখা যায়, ঘর-বাড়ি ভেঙে নিয়ে কলার গাছের ভেলায় মালামাল তুলছেন হায়দার আলী নামের এক জন।

ঘটনা কি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, বানের পানিতে ঘরবাড়ি ডুবায়ে রাক্ষুসী গাঙ্গ শান্তি পায়নি। এখন ঘর-বাড়ি গিলতে (ভাঙতে) শুরু করছে ওর পেটের ক্ষিধা মিটাতে। তাই এগুলো ভেঙ্গে নদীর বাঁধে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি।

ঘাঘট নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে এর আগে আরও পাঁচবার ঘর-বাড়ি ভেঙেছেন বলে জানান তিনি।

পানি তলিয়ে যাওয়ায় গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার ইতোমধ্যে ঘরবাড়ি ছেড়ে সাদুল্লাপুর ডিগ্রি কলেজ ও সাদুল্লাপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।এখনও সাড়ে ৫০০ পরিবার এই অবস্থার মধ্যেই ঘরবাড়ি আকরে পড়ে আছে।

তাদের টয়লেট, নলকূপ সব এখন পানির নিচে।। পানির মধ্যে তাদের পয়:নিষ্কাশন এবং ডুবন্ত নলকূপের পানি পান করছে তারা। মাচা করে রাত যাপন করছে।

এ অবস্থায় দিন কাটালেও উ খোঁজখবর নিতে আসেনি। মেম্বর একটি নামের তালিকা করে নিয়ে গেছে, এই পর্যন্ত শেষ বলে অভিযোগ ওই গ্রামের বাসিন্দাদের।

একই রকম চিত্র ইউনিয়নের হিয়ালী, বনগ্রাম ইউনিয়নের জয়েনপুর ও মন্দুয়ার গ্রামের।

তবে এর মধ্যে শুধু জয়েনপুরগুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকদিন আগে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছেন বনগ্রাম ইউপির চেয়ারম্যান।

জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় আব্দুস ছত্তারের মত নদী তীরবর্তী প্রায় আড়াই লাখ পানিবন্দি মানুষের জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্য আসেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, রসুলপুর ইউনিয়নে ৪ মেট্রিক টন, নলডাঙ্গায় ৫ মেট্রিক টন, দামোদরপুরে ৩ মেট্রিক টন, বনগ্রামে ২ মেট্রিক টন ও কামারপাড়ায় ২ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

এছাড়া বনগ্রামে নগদ ১৬ হাজার টাকা ও কামারপাড়ায় ৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, শুক্রবার আরও ৯ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৯ হাজার টাকা নতুন বরাদ্দ পাওয়া গেছে। 

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জানান, বন্যায় এ উপজেলার নলডাঙ্গা, কামারপাড়া, বনগ্রাম, রসুলপুর, দামোদরপুর জামালপুর, ইদিলপুর ও ভাতগ্রাম ইউনিয়নের ৫৩টি গ্রামের ২১ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি।

টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

এছাড়া রৌমারী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে এক শিশু।

উপজেলার শৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, লাউবাড়ী গ্রামের আনিসুল (৭)  নামে এক শিশু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।

জিঞ্জিরাম আর ধরনী নদীর তীব্র স্রোতে সুতিরপাড়, ইজলামারী,গাটিয়ামারী,নওদেশপাড়া এলাকার বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ভেঙ্গে গিয়ে পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। প্রবল স্রোতের কারণে ধল্লারপাড় এলাকায় কুড়িগ্রাম-যাত্রাপুর সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

ব্রক্ষপুত্র,জিঞ্জিরাম,ধরনী নদীর অববাহিকায় রৌমারী উপজেলার নওদাপাড়া, নতুন বন্দর, ব্যাপারীপাড়া, মোল্লাপাড়া, চান্দারচর, বয়তুল্লার চর, চর ইটালুকান্দা, উত্তর ফুলবাড়ী, চেংটা পাড়া, সবুজপাড়া, নতুন শৌলমারী এবং ঝাউবাড়ী গ্রামে ঘরে পানি উঠায় দুই থেকে তিন হাজার মানুষ গয়াটাপাড়া বিওপি ক্যাম্পে এবং বিভিন্ন উঁচু রাস্তায় পলিথিন টাঙিয়ে বৃষ্টির মধ্যে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

এখানকার গ্রামীনসড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নৌকা আর ভেলা। পানিবন্দি মানুষ খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানির চরম সংকটে পড়েছে।

বন্যার পানিতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়া গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসীরা। বন্যার পানি বাড়তে থাকায় গবাদি পশু নিয়ে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের গোয়ালী পাড়া গ্রামের জোবেদ আলী জানান, হু হু করে পানি বাড়ছে। বাড়িতে থাকার উপায় নাই। গরু-ছাগল রাখার জায়গা নেই। গরু নিয়ে উঁচু জায়গায় যাচ্ছি। চুরি হওয়ার ভয় আছে। তাই রাত জেগে পাহারা দিতে হবে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের শমসের আলী জানান, এবারের বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। আমন ক্ষেত, সবজি ক্ষেত সব পচে গেল পানিতে।

জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, জেলায় বন্যা কবলিত মানুষের জন্য নতুন করে  আরও তিন লক্ষ টাকা এবং ১০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছি।

নতুন করে আরও ৫০০ মেট্রিক টন চাল এবং ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক শওকত আলী সরকার জানান, চলতি বন্যায় ৫৮ হাজার ৬শ ৭৪ হেক্টর জমির আমন এবং সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে জেলার ২ লক্ষ ৫০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।