জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বাদীর অসমাপ্ত জেরা এবং জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৩ অগাস্ট পরবর্তী দিন রেখেছে আদালত।
Published : 23 Jul 2015, 12:44 PM
বৃহস্পতিবার ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এই তারিখ ঠিক করে দেন।
বকশিবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কারা অধিদপ্তর প্যারেড মাঠে বিশেষ এজলাসে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানি চলছে।
সোয়া পাঁচ কোটি টাকা দুর্নীতির এ দুই মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতে পৌঁছান। আদালত কক্ষে ঢোকার সময় তিনি সবার সঙ্গে সালাম বিনিময় করেন। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় শুনানি চলার পর বিএনপি নেত্রী গুলশানে তার বাসায় ফিরে যান।
গত ১৮ জুন জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদকে জেরা শুরু করে আসামিপক্ষ। বৃহস্পতিবার খালেদার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাদীর অসমাপ্ত জেরা শুরু করেন।
এক ঘণ্টার বেশি সময় জেরা চলার পর আসামিপক্ষ পরের তারিখে আবার জেরা করার অনুমতি চায়। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জেরার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বাদীর জবানবন্দি বাতিল করে নতুন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন খালেদা। কিন্তু গত ৬ জুলাই হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে জানিয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন জজ আদালতে এ মামলায় সময়ের আবেদন করেন।
এরপর বিচারক বিষয়টি নথিভুক্ত করে ৩০ জুলাই সাক্ষ্য ও জেরার পরবর্তী তারিখ দিলেও খালেদার আইনজীবীদের অনুরোধে পরে ৩ অগাস্ট দিন ঠিক করে দেন।
২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট এবং ২০১০ সালের ৮ অগাস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দুটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলা দুটিতে প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ৭১ লাখ ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ এবং দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ করেছে দুদক।
বিএনপি দাবি করে আসছে, তাদের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলা করা হয়েছে এবং তা এগিয়ে নিচ্ছে বর্তমান সরকার।
জেরায় যা হল
খন্দকার মাহবুব হোসেন জেরায় বাদী হারুনুর রশিদকে প্রশ্ন করেন- “বার্জ মাউন্টেড দুর্নীতি মামলায় বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে টাকা নেন প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) – এ অভিযোগে দুদক মামলা করে। পরে বলা হয় – এটি মিথ্যা মামলা। এ বিষয়ে আপনি জানেন?”
উত্তরে হারুনুর রশিদ বলেন – জানা নেই।
এরপর নাইকো মামলা নিয়ে জেরায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী বলেন, “ডিসকোয়ালিফাইড গ্যাসফিল্ড ইজারা দেওয়া হয়েছিল– যে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছিল। ১৩০ বিলিয়ন টাকার ক্ষতি হয়েছিল। আপনি জানেন?”
উত্তর- “জানা নাই।”
খন্দকার মাহবুব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা খাটিয়ে তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৫টি মামলা থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, দায়মুক্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল করা হয়েছে।”
বাদী উত্তরে বলেন – “সত্য নয়।”
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এ সময় আপত্তি জানিয়ে বলেন, “দুদক এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনো মামলা প্রত্যাহার চায়নি। এবং এটা আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি।”
খন্দকার মাহবুব হোসেন এরপর বিষয়টি ঘুরিয়ে বলেন – “প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট হয়েছে, কিছু মামলা অন্যভাবে বাতিল হয়েছে- এটা কী ঠিক আছে? এবং এই মামলাগুলো অন্যায়ভাবে বাতিল হল, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ বা দুদক আপিল করেনি।”
এবার নিরুত্তর থাকেন দুদক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ।
খন্দকার মাহবুব এরপর জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের ডিড নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেন।
বাদীকে তিনি বলেন, “আপনি তো ট্রাস্ট ডিড দেখেছেন, অনুসন্ধান করেছেন। আপনি কী কী দেখেছেন? কোনো দুর্নীতি তো এর মধ্যে পাননি।”
উত্তর আসে – “না, আমি অনুসন্ধানে অনেক দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছি।”
উত্তর আসে – “হ্যাঁ, ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে এবং এ কারণে দুর্নীতি হয়েছে।”
প্রশ্ন – “তাহলে তো আত্মসাতের ঘটনা ঘটেনি। তাই না?”
উত্তর – “আত্মসাতের কোনো মামলা করা হয়নি।”
খন্দকার মাহবুব বলেন, “দেখুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো তিনি (খালেদা) ট্রাস্ট ডিড করেননি। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে এই ডিড করেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ঠিকানাও ট্রাস্ট ডিডে ব্যবহার করেননি। ঠিক কি না?
“অথচ আপনি এজাহারে লিখলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। কীসের ভিত্তিতে লিখলেন? অনুমানের ভিত্তিতে?”
বাদী উত্তরে বলেন, “না, এ সম্পর্কে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে।”
এরপর খালেদার আইনজীবী জানতে চান, “কী ধরনের দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। দলিলগুলো কী কী? সেগুলো দেখান।”
বাদী উত্তরে বলেন, “সেগুলো বিজ্ঞ আদালতের সামনে মামলার নথির মধ্যে রয়েছে।”
তিনি অনেক ভেবেচিন্তে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর খন্দকার মাহবুব বলেন, “আপনি কোন আইনজীবীর পাল্লায় পড়েছেন বুঝেছেন?”
এরপর আইনজীবী প্রশ্ন করেন – “ক্ষমতার অপব্যাবহার কিংবা টাকা আত্মসাতের কোনো অভিযোগ কী কেউ দুদকে করেছিল?”
উত্তর- “ডা. ফারজানা আহমেদ নামে একজন অভিযোগ করেন।”
প্রশ্ন – “এই ফারজানাকে কী আপনি সাক্ষী করেছেন মামলায়?”
এ পর্যায়ে খন্দকার মাহবুবকে থামিয়ে দিয়ে বিচারক বলেন, সাক্ষী করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অভিযোগকারীর নাম গোপন রাখারও আইন রয়েছে।
খন্দকার মাহবুব তখন বলেন, “দেখুন, ফারজানা নামে কোনো মহিলা অভিযোগকারী হিসেবে ছিলেন না । এটা কল্পনাপ্রসূত। মামলা দাঁড় করানোর স্বার্থে আপনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলছেন না।”
হারুন নির্বাক হয়ে গেলে বিচারক তাকে বলেন, “চুপ করে আছেন কেন? বলুন। আপনার উত্তর আমি কী লিখব?”
উত্তরে আসামির আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বাদী বলেন, “আপনি যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়।”
এ সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, “জিয়াউর রহমানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে এ ট্রাস্ট করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয়। এ কারণে উনার দুই পুত্র এখানে ট্রাস্টি হয়েছেন।”
উত্তর আসে, “সত্য নয়।”
এরপর প্রশ্নকর্তা বলেন, “বাইরে থেকে কোনো দান বা অনুদান নেওয়া যাবে না- এমন কোনো নিয়ম কি আপনি ডিডে দেখেছেন?”
বাদী উত্তরে বলেন, “না, পাঁচ লাখ টাকার একটা লিমিট দেখতে পেয়েছি। এটা ট্রাস্টের সদস্যদের জন্য।”
এরপর খালেদার আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দন খোকন বলেন, “জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকক্ষণ জেরা হয়েছে। আমরা আজকের মতো মুলতবি চাই, সামনের তারিখে আবার জেরা করব।”
পরবর্তী তারিখ নিয়ে আলোচনার পর বিচারক ৩ অগাস্ট তারিখ রাখেন।
আইনজীবীর কাণ্ড
শুনানির শেষ পর্যায়ে মোশররফ হোসেন কাজল মামলার পরবর্তী তারিখ নিয়ে কথা বললে আসামীপক্ষের একজন কনিষ্ঠ আইনজীবী ধমকে উঠে বলেন, “চুপ কর ব্যাটা!”
এ সময় বিচারক আসামিপক্ষকে সতর্ক করে বলেন, “কোন আইনজীবী এই হুমকিটা দিল? একজন আইনজীবীর মুখে এইসব শোভা পায়? এ ধরনের আচরণ সংঘাতময়। এ ধরনের আচরণ এজলাসে ঢোকাবেন না।”
এরপর খালেদার আরেক আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন সব আইনজীবীর পক্ষ থেকে বিচারকের কাছে ক্ষমা চান।