পাকিস্তানে নির্বাচনের আগে ইমরানকে ঘিরে বিভক্তি

পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ অস্বাভাবিক না হলেও ইমরান খানকে নিয়ে পাকিস্তানে এই সম্পর্কগুলোতে যে চিড় ধরেছে, তেমনটি আর কোনও রাজনীতিবিদকে ঘিরেই হয়নি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2024, 01:39 PM
Updated : 6 Feb 2024, 01:39 PM

পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরের বাসিন্দা নিদা জিশানের বাড়িতে একটি নিয়ম আছে। তা হল, পরিবারের সদস্যরা এক হলে রাজনীতি নিয়ে কোনও আলাপ চলবে না। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জিশানদের বাড়িতে এ নিয়ম চালু হয়েছিল।

জিশান নিজেকে ইমরানের একজন ঘোর সমর্থক বলেই পরিচয় দেন। তিনি বলেন, “আমার মনে আছে, বাবা ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানকে ভোট দেননি। এ জন্য আমি ও আমার বোন তিন মাস তার (বাবা) সঙ্গে কথা বলিনি। আমরা খাবার খাওয়া বা কিছু করার জন্যও একসঙ্গে পর্যন্ত বসতে পারিনি।”

পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া এবং পরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ইমরান খানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে মানুষের পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কে যে চিড় ধরেছে, তেমনটি আর কোনও রাজনীতিবিদকে ঘিরেই হয়নি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও পাকিস্তানের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে গতিশীল করার অঙ্গীকার নিয়ে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু ২০২২ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই তিনি কয়েকটি মামলা লড়ে আসছেন।

কয়েকটি মামলায় তার সাজা হওয়ার কারণে পাকিস্তানে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে তিনি লড়তে পারছেন না। ৭১ বছর বয়সী ইমরানের দাবি, নির্বাচন থেকে তাকে দূরে রাখতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার বিরুদ্ধে এতসব মামলা করা হয়েছে।

ইমরান নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারলেও নির্বাচনের আগে দিয়ে পাকিস্তানজুড়ে এখনও তাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে।

পরিবারে বিভক্তি:

লাহোরের বাসিন্দা জিশান বলেন, “আমি জোর গলায় বলতে পারি যে, আমি ইমরানকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার বাবা মনে করেন, তিনি (ইমরান) ভাল রাজনীতিবিদ নন।”

তবে ৩২ বছর বয়সী জিশান বলছেন, তিনি বিশেষ করে ইমরানের ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্রের (রিয়াসাত-ই-মদীন) আদর্শে আকৃষ্ট হয়েছিলেন; যে রাষ্ট্রে সবার জন্য সমতা থাকবে।

কিন্তু জিশানের বাবা জনতোষণবাদী (পপুলিস্ট) রাজনীতিবদ ইমরানকে সমর্থন করেন না। এর কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য। দেশটির রাজনীতিতে এই বাহিনীর গভীর প্রভাব আছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে তিন দশকের বেশি সময় সরাসরি দেশ শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। এখনও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।

পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রী কখনও পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। অথচ ৪ জন সামরিক স্বৈরশাসকের মধ্যে ৩ জনই ৯ বছরের বেশি সময় ধরে পাকিস্তান শাসন করেছিলেন।

জিশান বলেন, “আমি মনে করি, বাবা ইমরানকে তার অতীত জীবন দিয়ে বিচার করছেন। যা-ই হোক রাজনৈতিক মতপার্থক্যের সমাধান করা কঠিন। তাই আমরা যখন একসঙ্গে থাকি, তখন রাজনীতি নিয়ে কথা না বলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

ইমরান প্রথমে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বলে পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় আসার পরই দুইপক্ষের মধ্যে বিরোধ বাধে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইমরানের বিরোধে জাড়িয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

এরপর প্রধানমন্ত্রীত্বের চারবছরের মাথায় পার্লামেন্টে বিরোধীদের আনা অনাস্থা ভোটে ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হন। ইমরান অভিযোগ করেছিলেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে সমর্থন দিয়েছে। এই বিদেশি ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও জড়িত ছিল।

কিন্তু ইমরানের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী উভয়ই। ইমরানের সমর্থকরা এতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জিশানের সমমনা যারা তারা ইমরানের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

জিশান বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, ইমরান তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পাননি। তাছাড়া দেশের পরিস্থিতি ও অন্যান্য শক্তি তাকে কাজ করতে দেয়নি।”

ইমরান দুর্নীতি দূর করা এবং অর্থনীতিকে ঠিক করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূরণ করতে না পারায় পাকিস্তানিদের অনেকেই হতাশ। তবুও ইমরান কারাগারে থাকার পরও তার জনপ্রিয়তা কমেনি।

ডিসেম্বরে পরিচালিত একটি গ্যালপ জরিপে দেখা গেছে, ইমরানের জনপ্রিয়তা ৫৭ শতাংশ। আর তার প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফের ৫২ শতাংশ। গত মাসে ব্লুমবার্গ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, পাকিস্তানের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য কিছু পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞের কাছে পছন্দের শীর্ষে আছেন ইমরান।

পাকিস্তানের কিছু নাগরিক বলছেন, ইমরান নিজেকে একজন ‘পরিবর্তনের প্রার্থী’ হিসেবে চিত্রিত করে রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তানে পারিবারিক ধারার রাজনীতি অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের নবীপুরা গ্রামের কৃষক মুহাম্মদ হাফিজ বলেন, “ইমরান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) আমার মতো একজন গ্রামবাসীর কাছে এই বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন যে, কীভাবে দুটি দল জাতির সম্পদ লুট করেছে। তিনিই আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে পরিবর্তনের জন্য ভোট দিতে হয়।”

হাফিজ এখানে দুই দল বলতে, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বা পিএমএল-এন এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কথা বুঝিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিবারের নেতৃত্বাধীন এই দুই দল কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।

প্রতিপক্ষ দুটি দল পিএমএল-এন ও পিপিপি ২০২২ সালে ইমরান এবং তার দল পিটিআই-কে ক্ষমতাচ্যুত করতে এক জোট হয়েছিল। এবারের নির্বাচনে পিএমএল-এনের প্রার্থী নওয়াজ শরিফ জয়লাভ করে রেকর্ড চতুর্থ মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

নওয়াজের রাজনৈতিক ভাগ্যের নাটকীয় পরিবর্তন হিসেবেই দেখা হচ্ছে একে। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নওয়াজকে তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। অপহরণ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগে দোষীও সাব্যস্ত করা হয়।

সৌদি আরবে নির্বাসনে ছিলেন নওয়াজ। ২০০৭ সালে তিনি পাকিস্তানে ফেরেন। ২০১৩ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

এরপর ২০১৭ সালে পানামা পেপারস-সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্তের আওতায় নওয়াজকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। পরের বছর ঘুষ দুর্নীতির মামলায় তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলে ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম হয়।

এবার আবার দেখা যাচ্ছে ঠিক উল্টো চিত্র। এবারে ইমরান কারাগারে। আর নওয়াজের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম। অনেকেই এবার নওয়াজকেই সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী মনে করছেন।

কৃষক হাফিজের মতে, ইমরান মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছেন। আগে মানুষ নিজেদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল না।

তবে অন্যান্য পর্যবেক্ষকের অভিযোগ, ইমরানের রাজনীতি মানুষকে কেবল উত্তেজিত করা আর জনতোষণবাদ ছাড়া কিছুই না।

সামরিক পরিমণ্ডলে দ্বন্দ্ব:

কেউ কেউ মনে করেন, ইমরানের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরেই চূড়ান্তভাবে পাকিস্তানের রাজনীতির নিয়ন্তা। তাদেরকে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ বলা হয়।

পাকিস্তানের অন্যান্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়ালেও ইমরানকে ঘিরে সামরিক পরিমন্ডলে যেমন দন্দ্ব দেখা গেছে, তেমনটি আর কারও ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি।

পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাদের অভিযোগ, একথা বলে তারা সামরিক নেতাদের রোষে পড়েছেন।

একজন অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বলেন, তাকে ইমরানের পক্ষে কথা বলা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমি বলেছি, আমি তার (ইমরান) পক্ষে কথা বলছি না। আমি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও কথা বলছি না। আমি কিছু ব্যক্তির নীতি ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বলছি, যারা দেশের ক্ষতি করছেন।”

কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বিবিসি-কে বলেন, ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট সমর্থন না করায় তাদেরকে দোষারোপ করা হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, তাদের পেনশন ও অন্যান্য সরকারি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে।

আবার কাউকে কাউকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তখন থেকে অনেকেই চুপ হয়ে গেছেন।

বিবিসি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করলেও কোনও জবাব পায়নি। গত বছর সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, “অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর সম্পদ। কিন্তু তারা আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাদের রাজনৈতিক আবহে থাকা কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়া উচিত নয়।”

ইমরান এখন কারারুদ্ধ। নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে তাকে। তারদল পিটিআই’ও বড় ধাক্কা খেয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন গত মাসে ব্যালট পেপারে দলটির ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিষিদ্ধ করায়। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে, ইমরানকে ভালভাবেই নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তাতে কী? ইমরানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানজুড়ে রাজনৈতিক বিভাজনই বরং আরও গভীর হওয়ার পথে যাচ্ছে।

লাহোরে ইমরানের সেই সমর্থক জিশান বলেছেন, এমনকী বন্ধুরাও তার রাজনৈতিক সীমারেখা জানে। কেউ এই সীমারেখা অতিক্রমের চেষ্টা করলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে দেখা করা বন্ধ করে দেন। আর তা না করা হলে সাধারণত একে অপরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চলে।