পারভেজ মোশাররফ: প্রতাপশালী সেনাশাসক থেকে যিনি হারিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে

অ্যামাইলয়েডোসিস নামের এক বিরল রোগের আক্রান্ত পাকিস্তানের সাবেক এই সেনাশাসক রোববার দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2023, 02:32 PM
Updated : 5 Feb 2023, 02:32 PM

সেনাপ্রধান থেকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে হয়েছিলেন সেনাশাসক। দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে প্রায় নয় বছর পাকিস্তানকে শাসন করেছেন। যেভাবে ধূমকেতুর গতিতে তার উত্থান হয়েছিল, পতনও ঠিক একই গতিতে হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে একসময় তিনি হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে।

ছোট্ট কিন্তু বৈচিত্রময় রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ। জীবনের শেষ কয়কটি বছর তাকে দেশ ছেড়ে নির্বাসিত থাকতে হয়েছে। শেষ ইচ্ছা হিসেবে দেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করার সুযোগ দেওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি, আর কোনও দিন হবেও না। কারণ, তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। অ্যামাইলয়েডোসিস নামের এক বিরল রোগের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা:

১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ মোশাররফ। দেশভাগের পর তার পরিবার পাকিস্তানের করাচিতে চলে যায়। সেখানে সেন্ট প্যাট্রিকস স্কুলে লেখাপড়া শেষে ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে কাকুলের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন পান তিনি।

১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় পারভেজ মোশাররফের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়। তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের এলিট স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপে (এসএসজি) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এসএসজির একটি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তী সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন সামরিক দায়িত্ব পালন করেন। এই সুবাদে তিনি সেনাবাহিনীতে দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৯৮ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশটির সেনাপ্রধান হিসেবে পারভেজ মোশাররফকে নিয়োগ দেন। পরের বছরই রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি সেই নওয়াজ শরিফ সরকারকেই উৎখাত করে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন।

১৯৯৯ সালের সেনা অভ্যুত্থান:

১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর মোশাররফ শ্রীলঙ্কা সফর শেষে দেশে ফিরতে গেলে নওয়াজ সরকার তাকে বহন করা উড়োজাহাজ করাচিতে অবতরণ করতে বাধা দেয়। যার জেরে ওইদিনই সেনাসদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর ভবন দখল করে।

তারপর মোশাররফ দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন এবং পাকিস্তানের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। ওই সময়ে তার বা সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে তেমন কোনো বিক্ষোভ হয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিন্দা জানানো হয়েছিল।

পাকিস্তানের দশম প্রেসিডেন্ট:

২০০১ সালের জুনে পাকিস্তানের দশম প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল (অব.) মোশাররফ।

মোশাররফ প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই কুখ্যাত নাইন/ইলেভেন হামলা হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জঙ্গি দল আল কায়দা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা চালিয়ে তা গুড়িয়ে দেয়।

ওই হামলার পর মোশাররফের পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ যোগ দেয়। পরে একাধিক অনুষ্ঠানে সাবেক এ সেনাশাসক তার ওই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত মোশাররফ বলতে গেলে পাকিস্তানে একক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ওই সময়ে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট গঠন করে সংবিধানে নানা পরিবর্তন আনেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৯৯ সালের সেনা অভ্যুত্থানকে আইনি বৈধতা দেওয়া।

২০০৪ সালে তিনি পাকিস্তানের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে আস্থা ভোটে জিতে যান। ২০০৬ সালে তার আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ প্রকাশ পায়।

মোশাররফের সিংহাসন টলে উঠতে শুরু করে ২০০৭ সালে গিয়ে। ওই বছর মার্চ মাসে তিনি পাকিস্তানের ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরিকে বরখাস্ত করেন। যার বিরুদ্ধে আইনজীবী ও সাধারণ মানুষরা তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। যা তার প্রেসিডেন্ট পদের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২০ জুন সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্ট মোশাররফের দেওয়া বরখাস্তের আদেশকে বাতিল ঘোষণা করে ইফতেখার মুহাম্মদ চৌধুরিকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন।

ক্ষমতায় টিকে থাকতে ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর মোশাররফ পুনরায় পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন। জরুরি অবস্থা জারির ২৫ দিনের মাথায় তিনি সেনাপ্রধানের পদ ছাড়েন, তবে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকেন। ২০০৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নেন।

অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ:

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে পিপিপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ‍তারা মোশাররফকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের প্রস্তাব দিলে তিনি তাতে রাজি হননি। তখন পার্লামেন্টে থেকে তাকে অভিশংসিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‍অভিশংসন প্রক্রিয়া যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন পদত্যাগ করেন মোশাররফ।

পদত্যাগের পর তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। যার মধ্য অন্যতম পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো হত্যা মামলা।

এসবের মধ্যেই ২০১০ সালে অল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এপিএমএল) নামে একটি দল গঠন করে রাজনীতিতে ফেরার চেষ্ট‍া করেছিলেন মোশাররফ।

নির্বাসিত জীবন এবং দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি:

তার নামে বিভিন্ন মামলা বিচারাধীন থাকায় ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল মোশাররফের নাম পাকিস্তানের এক্সিট কন্ট্রোল লিস্টে (ইসিএল) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া জরুরি জানিয়ে বার বার সরকারের কাছে আবেদন করার পর এবং আর কখনো দেশে ফিরবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে দুবাই যাওয়ার অনুমতি দেয়।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জানা যায়, মোশাররফ অজানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। যে কারণে তার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। একমাস পর জানা যায় তিনি অ্যামাইলয়েডোসিস নামের এক বিরল রোগে আক্রান্ত। ২০১৯ সালের মার্চে এ রোগের কারণে প্রথম তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।

ওই বছর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে মোশাররফকে দোষীসাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পিএমএল-এন তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারির কারণে ওই মামলা করেছিল। পাকিস্তানে এ ধরনের মামলায় শাস্তির নজির সেটাই প্রথম ছিল।

যদিও একমাস পরই ওই মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে লাহোর হাইকোর্ট।

ততদিনে মোশাররফের শরীরিক অবস্থাও বেশ খারাপ হয়ে গেছে। জীবনের শেষদিনগুলো দেশের মাটিতে কাটাতে তাই তিনি বার বার তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন।